হাইকোর্টে রিট আবেদন বা দেওয়ানি মামলা করে বাসা দখলে রেখেছেন সরকারের ৭৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় বরাদ্দ বাতিল করা, বরাদ্দের সময় শেষ হওয়া বা অন্যকে বাসা বরাদ্দ দেওয়ায় তাঁরা এসব মামলা করেন।
সরকারের আবাসন পরিদপ্তরের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৬ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী স্রেফ একটি মামলা ঠুকে এবং অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মচারীকে হাত করে ২০ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত একেকটি বাসায় অবস্থান করছেন। পাঁচ বছর ধরে মামলা চলছে এমন ফ্ল্যাটের সংখ্যা ৩৪টি এবং ১১ বছর ধরে মামলা চলা ফ্ল্যাটের সংখ্যা ২৫টি। বাকি চারটি ফ্ল্যাট বিভিন্ন সময় বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেগুলো মামলা করে দখলে রেখেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মচারী মামলার পরামর্শ দেওয়া, নথি সরিয়ে ফেলা বা মামলার কার্যক্রম থামিয়ে রাখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এসব করে তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। মামলা দায়ের করা কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আর্থিক সুবিধা দিয়ে ফাইলগুলো আটকে রাখার কথা স্বীকার করেছেন।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এমনও কয়েকটি রিট আবেদন আছে, যেগুলোর বিষয়ে গত পাঁচ থেকে সাত বছর মন্ত্রণালয় বা পরিদপ্তর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে রহস্যজনকভাবে চুপ রয়েছে। এমনকি কিছু ফাইলের নথিপত্র গায়েব হয়ে গেছে। সেখানে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, বদলিযোগ্য না হওয়ায় কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন একই দায়িত্বে থাকায় কারও কারও শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। মামলা মোকাবিলা না করা প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, পরিদপ্তরের নিজস্ব আইনজীবী নেই। মন্ত্রণালয়ে একজন আইন উপদেষ্টা থাকলেও এসব মামলা নিবিড়ভাবে দেখভাল করা হয় না।
আবাসন পরিদপ্তরে এখন জনবল রয়েছে ৪১৪ জন। এর মধ্যে আইনজীবী না থাকা প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, একটি আইন শাখা খোলার চিন্তা রয়েছে।
শুনানির অপেক্ষায় এক দশক: ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর সে সময়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এস এ মালেকের সহকারী একান্ত সচিব সহকারী অধ্যাপক এ কে এম রেজাউল করিমের নামে রাজধানীর ৯৪/এইচ, আজিমপুরের সরকারি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০০৩ সালে বাসাটির বরাদ্দ বাতিল হলে তিনি রিট আবেদন করেন।
রহস্যজনক কারণে ২০০৫ সালের পর থেকে মন্ত্রণালয় এই বাসার বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। রেজাউল করিম এখন ঢাকা কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর অন্যায়ভাবে তাঁকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছিল। এরপর বাসা থেকে উচ্ছেদ নোটিশ দেওয়া হলে তিনি আইনের আশ্রয় নিয়ে শুনানির অপেক্ষায় আছেন।
কর্মচারী হয়ে সচিব পদমর্যাদার বাসা: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুল খালেক মৃধা বিএনপি সরকারের শেষদিকে সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা (ডি-১ শ্রেণি) বাসা নেন। ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি ওই বাসা (বি-৬৯/ডি-১০, পাইকপাড়া) দখল করে আছেন।
আবদুল খালেককে এ ধরনের বাসা দেওয়া তাঁর পদবি অনুযায়ী ঠিক হয়নি মর্মে অভিযোগ করে ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আরেক কর্মচারী পেয়ার আহমেদ বাসাটি বরাদ্দ চান। চাকরির অবস্থান এক ধাপ ওপরে হওয়ায় পেয়ার আহমেদকেই বাসাটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবদুল খালেক বরাদ্দ বাতিলের বিরুদ্ধে এবং পেয়ার আহমেদ যাতে বাসায় উঠতে না পারে সে জন্য নিষেধাজ্ঞা চেয়ে উচ্চ আদালতে ২০০৮ সালে রিট আবেদন করেন। আদালত স্থগিত আদেশ দেন, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর এই মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ে। এর পর থেকে মন্ত্রণালয়, আদালত বা রিট আবেদনকারী কারও কোনো উদ্যোগ নেই।
ধানমন্ডি এলাকার বাসা বা ফ্ল্যাট: ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কের ৫২ নম্বর বাড়ির একটি সুপিরিয়র ফ্ল্যাট ২০০২ সালে বরাদ্দ পান সাবেক পিজি হাসপাতালের অধ্যাপক এ এন নাসিমউদ্দিন আহমেদ। এরপর অধিদপ্তর তাঁর বরাদ্দ বাতিল করে এবং ২০০৪ সালে তিনি একটি রিট আবেদন করেন। মামলা নিষ্পত্তি হওয়া সাপেক্ষে ২০১০ সালে ফ্ল্যাটটি যুগ্ম সচিব মো. নূর হোসেন তালুকদারকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি উঠতে না পারায় ওই কর্মকর্তাকে ধানমন্ডিতে আরেকটি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
পরিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, পিজি হাসপাতাল আগে সরকারি ছিল, এখন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সেখানকার চিকিৎসকের সরকারি বাসা পাওয়ার কথা নয়।
আবাসন পরিদপ্তর সূত্র জানায়, ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর সুপিরিয়র শ্রেণির বাড়িটি (ফ্ল্যাট ৩/৫) দখলে রেখেছেন অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া যুগ্ম সচিব সামসুদ্দিন আহমেদ। ২০১২ সালে তিনি রিট আবেদন করেন। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট স্থগিত আদেশের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর আর কোনো তথ্য নথিতে নেই।
ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কের ২২ নম্বর বাড়িটি (ফ্ল্যাট ২/৯) খালি থাকলেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় কাউকে বরাদ্দ দিতে পারছে না অধিদপ্তর।
২২ বছর দখলে আজিমপুরের আটটি বাসা: ১৯৯২ সাল থেকে আজিমপুর কোয়ার্টারের আটটি বাসা নিয়ে মামলা চলছে। প্রতিটি মামলা হয়েছে দেওয়ানি আদালতে। প্রায় সব মামলার আদেশে উভয় পক্ষকে (বাসা দখলে রাখা ও বরাদ্দকারী কর্তৃপক্ষ) মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
আবাসন পরিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের মামলায় রিট হতে পারে। সরকারের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা হতে পারে না।
আজিমপুর কোয়ার্টারে সরেজমিন গিয়ে এমন কয়েকটি বাসা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়। ৩০/ও কোয়ার্টারে আছেন নিরীক্ষক রওশন আরা বেগম। তাঁর বাবা অবসরে যাওয়ার পর তিনি বাসাটি বরাদ্দ চান। কিন্তু নিম্নমান সহকারী হিসেবে তিনি ওই বাসার যোগ্য ছিলেন না। আবাসন পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ওই বাসাটি এ পর্যন্ত তিনজনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়, কেউই উঠতে পারেননি।
রওশন আরা প্রথম আলোকে জানান, ১৯৯২ সালে দেওয়ানি আদালত স্থগিত আদেশ দেওয়ার পর থেকে তিনি ওই বাসায় আছেন। এখন তিনি ওই বাসা পাওয়ার যোগ্য হয়েছেন। তাই এটা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।
১/এ, আজিমপুর কোয়ার্টারটি ১৯৯৮ সালের ১৩ নভেম্বর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নিম্নমান সহকারী মো. মোখতারউদ্দিনের নামে সাময়িক বরাদ্দ করা হয়। তাঁর পিতা ওয়াজিউল্লাহ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান মৌলভি হিসেবে ওই বাসাটি পেয়েছিলেন। তাঁর পুত্র মোখতারউদ্দিনের বেতনস্কেল অনুয়ায়ী ওই বাসা প্রাপ্য না থাকায় আবাসন পরিদপ্তর স্থায়ী বরাদ্দ দিতে পারেনি। এরপর মোখতার দেওয়ানি আদালতে মামলা করেন। আদালত স্থগিত আদেশ দিয়ে বলেন, যোগ্যতা অনুযায়ী বাসা বরাদ্দ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ওই বাসায় থাকবেন। রহস্যজনক কারণে অধিদপ্তর ওই মামলা খারিজের উদ্যোগ নেয়নি।
১৯৯১ সালে আরেকটি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয় পরিসংখ্যান সহকারী সেলিনা সুলতানাকে। এরপর ২০১০ সালের জুনে রুমানা সিদ্দিকী এবং জুলাইয়ে মাসরুদা খানমকে একই বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখন ওই বাসায় কে আছে, তা পরিদপ্তরের নথিতে উল্লেখ নেই।
আজিমপুরের কোয়ার্টারগুলোর মধ্যে আদালতের রায় নিয়ে দখলে থাকা বাসার সংখ্যা আরও প্রায় ৩০টি। মামলা থাকায় মতিঝিলের কমপক্ষে এক ডজন বাসা বরাদ্দ দিতে পারছে না আবাসন পরিদপ্তর। ইলিসিয়াম রেস্ট হাউসের সাতটি কক্ষ, সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসের চারটি কক্ষ মামলা করে দখলে রেখেছেন বরাদ্দপ্রাপ্তরা। এ ছাড়া ইস্কাটন গার্ডেন, উত্তরা, শাহজাহানপুর, গ্রিন রোড, শেরেবাংলা নগর, পলাশী, সোবহানবাগ, আগারগাঁও এলাকার বেশ কয়েকটি বাসা বা ফ্ল্যাট আইনের মারপ্যাঁচে পড়েছে।
ইস্কাটন গার্ডেনের কাজলির একটি বাসা অতিরিক্ত কর কমিশনার আ জা ম জিয়াউল হকের দখলে রয়েছে। ঢাকার বাইরে বদলি হওয়ার পর বরাদ্দ বাতিল করলে ২০১২ সালে তিনি রিট আবেদন করেন। এ বছরের ২৬ জানুয়ারি তাঁর সর্বশেষ স্থগিতাদেশের ছয় মাস মেয়াদ পার হয়েছে। এরপর পরিদপ্তরের কাছে কোনো তথ্য নেই।
এই পরিদপ্তরের আওতায় বিভিন্ন শ্রেণির মোট বাসা রয়েছে ১২ হাজার ৯৬০টি। এর বাইরে সরকারের বদলিযোগ্য কর্মকর্তাদের জন্য ৭১৬টি বাসা রয়েছে। কিন্তু অস্থায়ী ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও এগুলো স্থায়ী হয়ে গেছে। বাসা বরাদ্দে দুটি কমিটি থাকলেও গত কয়েক বছর নথি বা অফিস আদেশের মাধ্যমে এগুলো বরাদ্দের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু বাসাগুলো নিয়ে মামলা চলছে সেহেতু তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না।