যুদ্ধসাজে সজ্জিত দুই সৈনিক। তবে পরনে ধূসর বা জলপাই পোশাক নেই। তাদের হাতে নেই বন্দুক। মাথায় নেই হেলমেট। এসবের বদলে তাদের গায়ে লাল আংরাখা, পায়ে নাগরা আর হাতে ঢাল-তলোয়ার। আঠারো শতকের যুদ্ধসাজে এই দুই পুতুল সৈনিকের দেখা মিলবে লালবাগ কেল্লা জাদুঘরে।
বাংলার সুবেদার থাকার সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবপুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ সালে লালবাগ দুর্গ তৈরির কাজ শুরু করেন। তবে নির্মাণ শেষ হয়নি। দুর্গ প্রাঙ্গণের দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম ভবন এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সতেরো শতাব্দীতে সুবেদার শায়েস্তা খানের বাসভবন হিসেবে এ ভবনটি তৈরি হয়। এর নিচতলার তিনটি ঘর নিয়ে এখন লালবাগ কেল্লা জাদুঘর।
প্রথম ঘরটিতে দরজার ডান পাশের দেয়ালে ১৮৪০ সালের লালবাগ দুর্গের একটি ছবি। ছবিতে দুর্গ ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা। গত প্রায় দুই শ বছরে বুড়িগঙ্গা অনেক দূরে সরে গেছে। ছবির তালিকায় আরও আছে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ, যুবরাজ আজম শাহ, সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রতিকৃতি।
এ ছাড়া কাচের বাক্সে রাখা আঠারো ও উনিশ শতকের লোহার জালের বর্ম। আছে হাতির দাঁতের বাঁট লাগানো ছোরা। বাক্সে লাল মখমলের ওপর সাজানো আছে ‘গুপ্তি’ নামের বিশেষ অস্ত্র। সাধারণ বাঁশের বাঁশির মতো দেখতে। এই চিকন-ফাঁপা বাঁশের ভেতর লুকানো থাকত ধারালো ফলা।
জাদুঘরের দ্বিতীয় ঘরের মাঝখানে মার্বেলের রেলিংঘেরা একটি চৌবাচ্চা। তার ভেতরে একটি ঝরনা। তবে ঝরনাটি এখন অচল। এখানে আরও আছে চীনামাটির সঞ্চয়পাত্র, ধাতুর তৈরি সুরাহি, বক্ষবর্ম, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি।
এই ঘর থেকে ডান দিকে বাদশাহি স্নানঘর—হাম্মামখানা। মোগল আমলের চকচকে নীল-সাদা টাইলস এখনো শোভা পাচ্ছে হাম্মামের মেঝেতে। ঠান্ডা পানির সংরক্ষণাগার, চৌবাচ্চা, পোশাক বদলানোর ঘর আর শৌচাগার নিয়ে এই হাম্মাম। শাহি এই স্নানঘরে আরও ছিল গরম পানি ও গরম বাতাস প্রবাহের চুল্লি। চুল্লির সামনের খাঁজকাটা জানালায় দাঁড়িয়ে স্টিমবাথ নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
জাদুঘরের তৃতীয় ও শেষ ঘরে আছে ১৭ শতকের কোরআন শরিফ আর তফসিরের বই। বইয়ের পাতায় টানা টানা নিখুঁত আরবি হরফ, প্রতিটি পাতার মার্জিনে জটিল-সূক্ষ্ম কারুকাজ আর উজ্জ্বল সোনালি-নীল কালির ব্যবহার দেখে চোখ জুড়ায়। ক্যাপশনে লেখা না থাকলে হাতে লেখা বলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। এই ঘরেই আছে পারস্য থেকে আনা চারটি বিশেষ পাত্র। খাবারে বিষ আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য এগুলো ব্যবহার হতো। বিষাক্ত খাবার এ পাত্রে ঢালা হলে তার রং পাল্টে যেত।
জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা মো. আখতার হোসেন বললেন, দিনে প্রায় দুই থেকে তিন শ দর্শনার্থী জাদুঘরে আসেন। শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম ভবনের আর একটি অংশে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের প্রকাশনা বিক্রয়কেন্দ্র। এখানে লালবাগ কেল্লাসহ বাংলাদেশের প্রাচীন নিদর্শনগুলোর ছবির পোস্টার, ভিউকার্ড, ফোল্ডার এবং এগুলো নিয়ে লেখা বই বেশ কম দামে পাওয়া যায়।
লালবাগ কেল্লার প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। জাদুঘরের জন্য আলাদা কোনো প্রবেশমূল্য নেই। কেল্লার সময়সূচি অনুযায়ী অক্টোবর থেকে মার্চ মাস মঙ্গলবার থেকে শনিবার প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর সোমবার জাদুঘরের দরজা খুলবে বেলা ১টা ৩০ মিনিট থেকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সকাল ১০টা থেকে জাদুঘর খোলা থাকবে। এ ছাড়া সারা বছরই রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ।