
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কাদরা গ্রামের বাসিন্দা জামাল হোসেন। তিনি বাড়ির পাশের রাস্তার দিকে যখন তাকান, তখনই তাঁর বুকটা খাঁ খাঁ করে। রাস্তার দুই পাশে একসময় গাছের সারি ছিল। ভোরে সেখানে পাখি বসত, দুপুরে দিত ছায়া। গাছের বদলে এখন সেখানে কাটা গুঁড়ি। ২৫ বছর পর আরও গাছ লাগিয়ে তা কেটে ফেলার পরিকল্পনা ছিল তাঁর।
সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বন বিভাগের সঙ্গে এমনই চুক্তি ছিল জামালের। তিনি গাছ বিক্রির ৫৫ শতাংশ অর্থ পাবেন। ১০ শতাংশ বন বিভাগ আর বাকিটা বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে।
কিন্তু বয়স নয় বছর পেরোনোর আগেই রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হলো তাঁর ৩০টি গাছ। গত ১২ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার দিন সহিংসতার শিকার হয় গাছগুলো। কাটা কিছু গাছ চুরি হলেও বেশির ভাগই বন বিভাগের লোকেরা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যান। গাছগুলো বিক্রি করে পাওনা টাকা দেওয়ারও আশ্বাস ছিল। এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো তিনি সাড়া পাননি।
তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক বনায়নের অংশীদারেরা গাছের কাটা অংশেরও দেখা পাননি। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিধন হওয়া বেশির ভাগ গাছ উদ্ধার করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, বৃক্ষনিধনের এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন। তাই সামাজিক বনায়ন বিধিমালায় এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই, যে কারণে অংশীদারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও সুযোগ নেই।
এভাবে গাছ নিধনের ঘটনাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক নতুন ধরনের সহিংসতার প্রকাশ বলে মনে করেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা। তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা বন বিভাগের যোগসাজশে দুর্বৃত্তদের হাতে বৃক্ষ ধ্বংস হতে দেখেছি। এখন রাজনৈতিক দলগুলো বৃক্ষনিধন তাদের কর্মসূচির অংশে পরিণত করছে। এ যেন “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়”।’ তিনি বলেন, সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি প্রকৃতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাতে হবে।”
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ১০ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় ৫০ হাজারের বেশি গাছ কাটা পড়েছে। এ পর্যন্ত বন বিভাগ মাত্র সাত হাজারের মতো গাছ উদ্ধার করেছে। পরিণত হওয়ার আগেই কেটে ফেলা ওই গাছগুলোর প্রতিটির দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর পরিণত হলে তা কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত। সেই হিসাবে রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট প্রায় ১০০ কোটি টাকার গাছ নিধন করা হয়েছে।
কাটা গাছগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় রোপণ করা হয়েছিল প্রায় ৪৫ হাজার।
সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০৪ অনুযায়ী, এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতায় কোনো গাছ কাটা পড়লে তার ক্ষতিপূরণের বিধান নেই। এর বাইরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাধ্যমে রোপণ করা গাছের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার।
বৃক্ষনিধনের এই হিসাবটি ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে তৈরি করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সে সময় মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নিধন হওয়া ৫০ হাজার বৃক্ষের মধ্যে ৪৫ হাজারই সামাজিক বনায়নের ও ব্যক্তিমালিকানাধীন। তিনি জানান, গত ১০ মাসে বন বিভাগ গাছ কাটার জন্য মোট ১৫০টি মামলা করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিধন হওয়া গাছের মধ্যে বেশি রয়েছে গামার, জারুল, ইউক্যালিপটাস, মেনজিন। সাম্প্রতিক সময়ে গাছ কেটে তা রাস্তায় ফেলে অবরোধ সৃষ্টির হার বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক করাতের ব্যবহার। দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছচোরেরা সাধারণত এই করাত ব্যবহার করে। সড়কের পাশে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন থেকে সংযোগ নিয়ে এই করাত দিয়ে ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে একটি গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়।
জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা পড়ে নোয়াখালী ও সাতক্ষীরায়। সেখানে নিধন হয় প্রায় ১২ হাজার গাছ। আর গত দুই মাসের সহিংসতায় বেশি গাছ কাটা পড়েছে রংপুর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে।
কোন সংস্থার কত গাছ: এলজিইডির হিসাবে রাজনৈতিক সহিংসতায় এ পর্যন্ত তিন হাজার ৫১০টি গাছের প্রাণ গেছে। এর আর্থিক মূল্য ৯৬ লাখ ১৩ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে সর্বোচ্চ এক হাজার ৬৯০টি, চট্টগ্রামে এক হাজার ১৮টি, খুলনায় ৬৩২টি গাছ কাটা হয়েছে। ঢাকা ও সিলেট বিভাগে নয়টি করে গাছ কাটা পড়েছে। বরিশালে এলজিইডির রোপণ করা কোনো গাছই কাটা পড়েনি। কাটা যাওয়া এসব গাছের বেশির ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর।
সওজের হিসাবে, তাদের রোপণ করা দুই হাজার ৬৪০টি গাছ কাটা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি গাছ নিধন হয়েছে। যার পরিমাণ এক হাজার ৪৫৫টি। এর পরই খুলনায় ৯৮টি, রাজশাহীতে ৬২টি, বরিশালে ১২টি, ঢাকায় নয়টি, কুমিল্লায় আটটি ও সিলেটে তিনটি গাছ কাটা পড়েছে। সওজের গাছগুলোর বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।