নাটোরে ভাষা প্রতিযোগ

রোদের তেজেও জমাট ভাষা উৎসব

নাটোর অঞ্চলের ভাষা প্রতিযোগ উৎসবে গান গাইছে বগুড়ার এক শিক্ষার্থী। গতকাল দিঘাপতিয়া এম কে (অনার্স) কলেজ মাঠ থেকে তোলা ছবি l সোয়েল রানা
নাটোর অঞ্চলের ভাষা প্রতিযোগ উৎসবে গান গাইছে বগুড়ার এক শিক্ষার্থী। গতকাল দিঘাপতিয়া এম কে (অনার্স) কলেজ মাঠ থেকে তোলা ছবি l সোয়েল রানা

তখন সকাল সাড়ে নয়টা। তবে প্রচণ্ড রোদের তাপে মনে হচ্ছিল দুপুর ১২টা বেজে গেছে। বিশাল ছাউনির ভেতর থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য। মুহূর্তে সবার শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। নিরুপায় হয়ে উদ্বোধনী বক্তব্য অতি সংক্ষেপ করে পতাকামঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়ালেন অতিথিরা।
এ রকম তাপ-দহনের মধ্যে গতকাল শনিবার নাটোরের দিঘাপতিয়া এম কে (অনার্স) কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হলো এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগের আঞ্চলিক উৎসব। প্রখর রোদ উপেক্ষা করে রাজশাহী, বগুড়া, নাটোর, জয়পুরহাট, পাবনা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৯৫৫ জন শিক্ষার্থী এ আয়োজনে অংশ নেয়।
সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে ভাষা প্রতিযোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন নাটোরের জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান। ভাষা প্রতিযোগের পতাকা উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন নাটোর বন্ধুসভার সদস্যরা। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ৩৫ মিনিটের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। এ পর্বে বুদ্ধিদীপ্ত ও মজার প্রশ্ন করে শিক্ষক ও ভাষাবিদদের চমকে দেয় এবং পুরস্কার জিতে নেয় অনেক শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুন অর রশীদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহালি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ভাষা প্রতিযোগের সমন্বয়কারী তারিক মনজুর, ড্যাফোডিল ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডক্টর বিনয় বর্মণ ও প্রথম আলোর উপ-ফিচার সম্পাদক জাহীদ রেজা নূর। প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যেই ভাষা নিয়ে গান গেয়ে শোনায় নাটোর নবাব সিরাজ উদ দৌলা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী অভিষেক মোহন্ত। বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুলের শিক্ষার্থী তানভীর হোসেন প্রশ্ন করে, বাংলা একাডেমী, রূপালী, সোনালী ও পূবালী ব্যাংক বানানে কেন ‘দীর্ঘ-ই কার’ লেখা হয়। জবাবে ডক্টর বিনয় বর্মণ বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সময় তাদের নাম আইন করে লেখা হয়েছিল। তাই এখন আর সেগুলো সংশোধন করা হয় না। একজন শিক্ষার্থী অভিযোগের সুরে বলে, ভাষা প্রতিযোগের ব্যানারে কেন এইচএসবিসি শব্দটি ইংরেজিতে লেখা হয়? উত্তরে এইচএসবিসি করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল জুবায়ের বলেন, ‘এটা ব্যাংকের লোগো হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এটা মানুষের কাছে এভাবেই পরিচিতি পেয়েছে। তাই তা বাংলায় লেখা সম্ভব হয় না।’ নাটোর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মাসরুরের প্রশ্ন, কেন মিনিট ও সেকেন্ড শব্দের বাংলা বলা হয় না। এর বাংলাই বা কী হবে? জবাবে এক শিক্ষক বলেন, এটা এভাবেই বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে।
প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যেই বক্তব্য দেন পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক শরীফ খান। তিনি বলেন, পাখিদের কোনো আঞ্চলিক ভাষা নেই। তারা অঙ্ক জানে। পাখিরা কখনো অপরিচ্ছন্ন থাকে না। নাচের সৃষ্টি পাখিদের কাছ থেকে।
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে বানান পরীক্ষার বিজয়ী আটজনকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আরেকটি বানান প্রতিযোগিতা। তাদের মধ্যে ঊর্মি ‘বানান বীর’ নির্বাচিত হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় পর্বে গান শোনান ক্লোজআপ ওয়ান তারকা শাহরিয়ার রাফাত। পরে আয়োজকদের পক্ষ থেকে দিঘাপতিয়া এম কে (অনার্স) কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাকের হাতে ভেন্যু স্মারক তুলে দেন জাহীদ রেজা নূর। শেষ পর্বে প্রতিযোগের লিখিত পরীক্ষার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন প্রথমা প্রকাশনের প্রধান সমন্বয়কারী জাফর আহমদ। পরে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা। প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—এই চারটি বিভাগে ১৫ করে মোট ৬০ জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হয়। বিজয়ীদের সনদ, পদক ও বই তুলে দেন অতিথিরা। বন্ধুসভার বন্ধুরা পরিয়ে দেন স্মারক টি-শার্ট। চার বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সেরাদের সেরা হয়েছে রাজশাহীর সরকারি পি এন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ঝুরাফা নাজিরাত গুণগুণ। বিজয়ী ৬০ জন শিক্ষার্থী ঢাকায় জাতীয় উৎসবে অংশ নেবে।