প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক: আসুন, মাসিক নিয়ে কথা বলি

লজ্জা নয়, সচেতন হতে হবে

বেসরকারি সংগঠন ওয়াটার এইড বাংলাদেশের সহায়তায় গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ‘আসুন মাসিক নিয়ে কথা বলি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা l ছবি: প্রথম আলো
বেসরকারি সংগঠন ওয়াটার এইড বাংলাদেশের সহায়তায় গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ‘আসুন মাসিক নিয়ে কথা বলি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা l ছবি: প্রথম আলো

বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে মাসের নির্দিষ্ট সময়ে ঋতুস্রাব বা মাসিক হয়। তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকেই সমাজে অনেক ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয় (ট্যাবু) হিসেবে ভাবা হয়। ফলে এ নিয়ে শুরু হয় রাখঢাক। সচেতনতার অভাবে এ সময়ে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর দেওয়া হয় না। ফলাফল হিসেবে জরায়ুমুখ ও প্রজনন অঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয়। যার দীর্ঘমেয়াদি কুফল বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। তাই এ বিষয়ে লজ্জা নয়, কথা বলতে হবে। সচেতন হতে হবে।
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এ অভিমত দিয়েছেন
গতকাল শনিবার সমাজের প্রায় নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত বিষয়টি নিয়েই প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটার এইডের সহায়তায় কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট, সাবান, পানি, ঢাকনাযুক্ত ন্যাপকিন ফেলার বাক্স এবং সচেতনতা তৈরিতে জাতীয় পর্যায়ে প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন। নোংরা ও পুরোনো কাপড়ের পরিবর্তে সহজলভ্য ন্যাপকিন বা প্যাড সরবরাহ বাড়াতে বেসরকারি সংগঠনের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান আলোচকেরা। আর এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারকে বিনিয়োগও করতে হবে।
বৈঠকের প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, মাসিকের সময় পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিলে পরে সংক্রমণসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় চিকিৎসকের পেছনে খরচ কমে যাবে।
মেহের আফরোজ মাসিক সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে আর্থিকসহ অন্যান্য শারীরিক কী কী ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া মাসিক সম্পর্কে সচেতনতার অভাবেই অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণসহ মেয়ে শিশু বিভিন্ন ঝঁুকির মধ্যে থাকে। এসব ঝঁুকি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অভিভাবকেরা মেয়েকে বাল্য বয়সেই বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই অভিভাবকসহ সমাজের সর্বস্তরে মাসিক নিয়ে সচেতন হতে হবে।
বৈঠকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন রিসার্চ গ্রুপের প্রধান লিয়ানে ইউনিকমব অপ্রকাশিত একটি সমীক্ষার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, কিশোরী এবং বয়স্কদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মাসিক হওয়ার আগেই মাসিক সম্পর্কে জানতে পেরেছে। মাসিকের সময় বেশির ভাগই পুরান কাপড় ব্যবহার করে। এক-পঞ্চমাংশেরও কম ঠিকমতো মাসিকের কাপড় পরিষ্কার করে, রোদে শুকায় এবং ভালো জায়গায় সংরক্ষণ করে। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের অর্ধেকই স্কুলে নারীবান্ধব অবকাঠামো এবং নিরাপত্তার অভাবে মাসিকের কাপড় পরিবর্তন করতে পারে না। প্রায় অর্ধেক কিশোরীই মাসিকের সময় স্কুলে যেতে পারে না। শিক্ষক, এনজিও বা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারছে মাত্র ৬ শতাংশ। ৪৮ শতাংশ বয়স্ক, ৩৮ শতাংশ কিশোরী এবং ৭৪ শতাংশ স্কুল পড়ুয়া মেয়ে মনে করে মাসিকের সময় কাজ বন্ধ রাখতে হয়। স্কুলপড়ুয়া ৪১ শতাংশই জানিয়েছে পূর্ববর্তী ছয় মাসে তারা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব দিলরুবা বলেন, সরকারের মোট কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ১২ শতাংশ নারী। এই কর্মীদের মাসের সাত দিন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় পরিষ্কার এবং পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা না থাকার কারণে। এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার পিছিয়ে আছে। তবে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনায় এবং নতুন ভবন তৈরিতে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷
স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক জুয়েনা আজিজ বলেন, এ বিভাগের পানি ও পয়ঃব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মধ্যেই মাসিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এসে যায়। তবে বিষয়টি এখনো আলোচনার মধ্যে আসেনি। তিনি নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট তৈরিতে বিভিন্ন বিপণিবিতানের মালিকসহ অন্যদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।
জীবনব্যাপী স্বাস্থ্যঝঁুকি : প্রসূতি ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত পেশাজীবীদের সংগঠন ওজিএসবির সভাপতি ও প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ লতিফা শামসুদ্দিন বলেন, মাসিকের ব্যবস্থাপনা না থাকায় স্কুলশিক্ষকেরা পর্যন্ত মানসিক সমস্যায় ভোগেন। পরিবারে বাবা-মা সন্তানদের এ বিষয়ে সচেতন করেন না। ফলে তারা একটি ভীতির মধ্য দিয়ে বিষয়টিকে মোকাবিলা করে। স্কুলে মাসিক হলে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। বাসায় মাসিকের কাপড় ধোয়ার জন্য আলাদা জায়গা থাকে না। ব্যাকটেরিয়াযুক্ত এ কাপড় ব্যবহারে জরায়ুমুখ ও প্রজনন অঙ্গ সংক্রমণের শিকার হয়। এতে ভবিষ্যতে সন্তান না হওয়া, মৃত সন্তানের জন্ম দেওয়া বা বারবার গর্ভপাত হতে পারে।
লতিফা বলেন, মাসিকের সময় একটু পেট ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। এ সময় শারীরিক কিছুটা পরিবর্তন হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই। মাসিকের সময় কাজ বন্ধ রাখারও প্রয়োজন নেই।
সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে: ওয়াটার এইডের দেশীয় প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম বলেন, সরকারি পর্যায়ে মাসিক সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে প্রচারের জন্য সরকারের বিনিয়োগ থাকতে হবে।
সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (প্রোগ্রাম) তছলিম উদ্দিন খান বলেন, মাসিক নিয়ে সচেতনতা জরুরি। সচেতনতার পাশাপাশি আচরণ পরিবর্তনের দরকার হয়। আর আচরণ পরিবর্তনের জন্য নোংরা কাপড় ব্যবহারের পরিবর্তে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হবে। এ ন্যাপকিন সহজলভ্য এবং হাতের নাগালে পেতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সরকার যেহেতু স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছে না, তাই যেসব সংস্থা এটি তৈরি করছে তাদের সহায়তায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
তছলিম উদ্দিন জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠান জয়া নামক একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছে। দেশের ১৯টি জেলায় এ পণ্যটি ব্যবহারে স্কুলছাত্রীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ইউনিটের পলিসি স্পেশালিস্ট নাদিয়া আফরিন শামস্ বলেন, ছেলে শিশুকেও মাসিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাকে বলতে হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মা, বোন বা মেয়ে সহপাঠীর মাসিক হয়। এ সময় লজ্জার কিছু নেই।
নাদিয়া জানান, ব্র্যাক কম মূল্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করছে।
এজেন্ডায় আনতে হবে: মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং) পরিচালক দিদারুল আলম বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে মাসিকের বিষয়টি সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্য বইতে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে বলা হয়েছে। তবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা তা কতটুকু পড়াচ্ছেন তা একটি বড় প্রশ্ন।
ওয়াটার এইডের পরিচালক (প্রোগ্রাম) হাসিন জাহান বলেন, বর্তমানে মেয়েদের নয় থেকে ১১ বছরের মধ্যেই মাসিক শুরু হচ্ছে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই। এ স্তরের পাঠ্যপুস্তক কারিকুলামেও কিছু বলা হয়নি। তারা বিষয়টি নিয়ে যাতে কোনো ধরনের ট্রমার মধ্যে না পড়ে তার জন্য এই বয়সকে টার্গেট করে বিভিন্ন কার্যক্রম নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্য) ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার চিকিৎসক নাসিমা খাতুন বলেন, অধিদপ্তরের স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম আছে। তবে এ প্রোগ্রামেও মাসিকের কথা বলা হয় না। বিষয়টিকে এজেন্ডার মধ্যে আনতে হবে।
দাতা সংস্থা ডিএফআইডির স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা উপদেষ্টা শেহলীনা আহমেদ বলেন, মা সন্তানকে সচেতন করবেন, কিন্তু সেই মায়েরও এ বিষয়টি সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। তাই এ বিষয়ে গার্ল গাইড, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়া ব্যবহার করে ঘরে ঘরে তথ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।