
একদিন কলকাতা পুলিশ নজরুলের বাড়ি তল্লাশি করতে এল। যদি কোনো নিষিদ্ধ বই পাওয়া যায়। বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয়শিখা ছিল তখন বাজেয়াপ্ত। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পুলিশ কিছু পেল না। তল্লাশিতে নজরুল কোনো বাধা দেননি। বাড়ির জিনিসপত্র সব লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। একটা সময় পুলিশের নজর গেল একটা বাক্সের দিকে। ওই দিকে এগিয়ে যেতেই কবি পাগলের মতো হয়ে গেলেন। তল্লাশি দলে থাকা পুলিশের প্রধান কর্মকর্তাকে বললেন, ‘আর যা-ই করুন, এ বাক্সে হাত দেবেন না।’ পুলিশ জেদ করে বাক্স খুলে দেখলেন। সেখানে ছোট একটি ছেলের জামা, খেলনা সুন্দরভাবে সাজানো। সেগুলো ছিল নজরুলের প্রয়াত ছেলে বুলবুলের স্মৃতি। লজ্জিত পুলিশ কর্মকর্তা দেখলেন, নজরুলের চোখে পানি টলমল করছে।
দ্রোহের কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে যাঁর পরিচয়, তাঁর মনে পুত্রস্নেহের এই কোমল দিকটি উঠে এসেছে আরেক ছেলে কাজী সব্যসাচীর স্মৃতিচারণামূলক লেখা ও সাক্ষাৎকারে।
বাবা হিসেবে সন্তানদের নিয়ে খুব ভাবতেন। চার বছরের ছোট্ট বুলবুল যখন মারা যায়, তখন তিনি পুত্রশোকে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।
বাবা প্রসঙ্গে কাজী সব্যসাচী বলেছিলেন, ‘এমন উদার হৃদয়বান বাবা কজন পেয়েছেন, জানি না। এদিক দিয়ে আমরা দুই ভাই ছিলাম সত্যিই ভাগ্যবান।’
কাজী সব্যসাচীর ডাকনাম সানি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রিয় চীনের বিপ্লবী নেতা সান-ইয়াৎ সেনের নাম থেকে এ নাম রাখা হয়। আর লেনিনের নাম অনুসরণে কাজী অনিরুদ্ধকে ‘নিনি’ নামে ডাকতেন কবি। কাজী নজরুলের চার ছেলে ছিল। প্রথম ছেলে কৃষ্ণ মুহম্মদ খুব ছোট বয়সেই মারা যায়। দ্বিতীয় ছেলে অরিন্দম বুলবুল মাত্র চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে মারা যায়।
‘তোমার সানি যুদ্ধে যাবে/ মুখটি করে চাঁদ পানা/ কোল ন্যাওটা তোমার নিনি/ বোমার ভয়ে আধখানা...’—ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধকে নিয়ে এ ছড়াটি প্রায়ই আবৃত্তি করতেন বাবা কাজী নজরুল ইসলাম। দুই ছেলেকে নিয়ে আরও ছড়া বানিয়েছিলেন নজরুল, ‘সানি নিনি দুই ভাই/ ব্যাং মারে ঠুইঠাই।’
কাজী সব্যসাচীর এক স্মৃতিচারণায় জানা যায়, যখন নজরুল পরিবার থেকে দূরে কোথাও যেতেন, নিয়মিত দুই ছেলেকে চিঠি লিখতেন। সব চিঠির শেষে থাকত ‘আমার চুমু নিও। ইতি বাবা।’
অসুস্থ হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে নজরুল কলকাতার বাগুইআটিতে একটা বাড়ি করার কথা ভেবেছিলেন। সেখানে কয়েক বিঘা জমির বায়নার টাকাও আগাম দিয়েছিলেন। প্রায়ই পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি সে জমি দেখতে যেতেন। বাসস্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন এইভাবে—‘বাড়িটা হবে বাংলো প্যাটার্নের। সামনে বা মাঝখানে একটা পুকুর থাকবে। পুকুরে মাছ ছাড়া হবে। প্রয়োজনমতো জাল কিংবা ছিপ ফেলে তা ধরা হবে। দক্ষিণ দিকে থাকবে আমার আর নিনির ঘর। তবে পুকুরের কাছে নিনি যাতে না যায়, তারও একটা ব্যবস্থা থাকবে, নিনি বড় শান্ত। সাঁতার জানে না।’
তবে সেখানে জমি কেনা হয়নি নজরুলের, বাড়িও করা হয়নি। একদিন সবাইকে নিয়ে বাগুইআটিতে গেছেন জমি দেখতে। কোথায় বাগান হবে, কোথায় বৈঠকখানা—এসব কথা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় হঠাৎ কী একটা উৎকট গন্ধে হকচকিয়ে গেলেন কবি। ওই সময় রাস্তা দিয়ে ময়লা ফেলা গাড়ি যাচ্ছিল। নজরুল নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পকেট থেকে সুগন্ধি বের করে নিজের নাকে লাগালেন। দুই ছেলের নাকে নাকে ঘষে দিয়ে বললেন, ‘না, এখানে বাড়ি করা হবে না। এই দুর্গন্ধে আমার লেখাটেখা বেরোবে না। ছেলেরা মারা পড়বে।’
দুই ছেলে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে প্রায়ই নাটক-সিনেমা দেখতে যেতেন নজরুল। বাড়ির বাইরে ছেলেদের নিয়ে গেলে সব সময় লক্ষ রাখতেন। কবি সময় পেলেই ফুটবল খেলা দেখতে যেতেন। একদিন দুই ছেলেকে নিয়ে নজরুল আইএফএ শিল্ডের মোহামেডান স্পোর্টিং বনাম কেওসিবির খেলা দেখতে গেছেন। খেলা শেষে হঠাৎ খেয়াল করলেন, সঙ্গে দুই ছেলে নেই। রীতিমতো চিৎকার শুরু করেছিলেন নজরুল, ‘সানি কোথায়, নিনি কোথায়?’ মাঠসুদ্ধ লোক হাঁ করে দেখছে। শেষে দুই ছেলে পেয়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি এসে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
আদরের পাশাপাশি শাসনেও ছিল নজরুলের নিজস্ব রীতি। একদিন দুপুরবেলা পরিবারের বড় সদস্যদের নিয়ে জমিয়ে তাস খেলছিলেন নজরুল। এই সময় সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ পাশের ঘরে কী করা যায়, সেই ভাবনায় অস্থির। অনিরুদ্ধ দেশলাই জোগাড় করে আনলেন। সব্যসাচী কাঠি জ্বালিয়ে সোফায় ধরিয়ে দিলেন আগুন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে চিৎকার শোনা গেল। হন্তদন্ত হয়ে সবাই ছুটলেন পাশের ঘরে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। দুটো সোফাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বুঝতে কারও বাকি রইল না এ কাদের কীর্তি। হুংকার ছেড়ে চোখ পাকিয়ে নজরুল এমন করে দুই ছেলের দিকে তাকালেন যে দুই ভাইয়ের হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল।