
ইট-পাথরের শহরে এ যেন সবুজের সমাহার। সবুজের মধ্যে মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মারছে নানা রঙের ফুল ও ফল। সারি সারি গাছ। ফুল-ফল-ঔষধি-পাতাবাহার-বনসাই কী নেই! পড়ন্ত বিকেলে ঝিরঝির হিমেল হাওয়ার যখন গাছগুলো দোল খাচ্ছিল, তখন পাল্লা দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল কয়েকটি পাখি ও প্রজাপতি। তাই একঘেয়েমি জীবনের ক্লান্তি দূর করতে কিছুটা সময়ের জন্য সবুজের বুকে ডুব দিয়ে আসতে পারেন নগরবাসী। বলছি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে চলা জাতীয় বৃক্ষমেলা-২০১৭-এর কথা।
‘জীবিকার জন্য গাছ, জীবনের জন্য গাছ’ স্লোগান নিয়ে গত ৪ জুন শুরু হয় মাসব্যাপী এই মেলা। তবে গত মাসের রোজা ও ঈদ থাকায় দর্শনার্থী কম ছিল। তাই সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে যেতে হলে হাতে সময় আছে মাত্র আর চার দিন। মেলা চলবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত।
গত শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটিতে মেলায় লোকসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই এসেছেন পরিবার নিয়ে। কেউবা এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে, আবার প্রেমিক যুগলেরও দেখা মিলেছে।
ছিমছাম মেলাপ্রাঙ্গণ। নেই টিকিট কাটার ঝামেলা, ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি। মেলায় আসা মা-বাবার সঙ্গে শিশুদের উৎসাহ ছিল বেশ। গাছের নাম, ফুলের নাম জানতে চাইছিল তারা। বাবার হাত ধরে মিরপুর থেকে এসেছে সাত বছরের মেয়ে মিম। দৌড়ে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছিল ফুল গাছের দিকে। এক-দুবার ফুল ছিঁড়ে বসে। তবে শিশুর কাণ্ড দেখে নার্সারির লোকজন বকা না দিলেও ফুল ছিঁড়তে হয় না বলে তাকে বুঝিয়ে দেয়।
আরেক নার্সারির গাছের সারিতে ঝুলে থাকা বড় বড় আম দেখে মুখ হা হয়েছে ছয় বছরের আবিরের। বলে বসে ‘এত্ত বড় আম’। শুধু যে শিশুরা তা নয়, বড়রাও কম যান না। বলধা গার্ডেনের নার্সারিতে ছিল বিশাল আকৃতির ‘আমাজান লিলি’। বড়-ছোট সবাই ছবি তুলতে বসে যান পাতার মতো দেখতে সেই লিলির পাশে।
বেশ ভিড় দেখা যায় আরেকটি নার্সারিতে। সেখানে আছে বিশাল আকৃতির ক্যাকটাস। নাম গোল্ডেন ব্যারেল। দাম হাঁকা হচ্ছে তিন লাখ টাকা। বলা হচ্ছে, এই ক্যাকটাসের বয়স ৫৫ বছর।
মেলায় প্রায় সব স্টলেই রয়েছে ড্রামে লাগানো আমগাছ। গাছে গাছে ঝুলছিল লাল, সবুজ, লম্বা, গোল নানা জাতের বিভিন্ন রং ও আকারের এই আম। নামও বাহারি। তোতাপুরি, পালমা, গৌড়মতি, পঞ্চকলা, ইটুআরটু। এ ছাড়া রয়েছে হলুদ-সবুজ ডোরাকাটা থাই মাল্টার চারা। চারা থেকে শুরু করে ফলসহ একেকটি গাছের দাম পড়বে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে একেক স্টলে একেক রকমের দাম চাইছিলেন বিক্রেতারা।
হোসেন নার্সারির মালিক সাদ্দাম হোসেন জানান, মেলায় আসা লোকজনের ফলের গাছের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তবে বেশি কিনছেন ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ। কারণ হিসেবে বললেন, ঢাকা শহরে বেশির ভাগ মানুষই ভাড়াটে। তাই বড় গাছ কিনতে চান না। জায়গার অভাবে বারান্দায় ফুলের গাছ লাগিয়ে তৃপ্ত তাঁরা। তাঁর স্টলে রয়েছে নলিনী পামগাছ। সাদ্দামের দাবি, এই গাছের বয়স ৬০ বছরের বেশি। তাঁর বাবা ১৮ বছর আগে থাইল্যান্ড থেকে গাছটি এনেছেন। ২০১৬ সালে দাম উঠেছিল ১ লাখ ৮০ হাজার। এবার দাম চাচ্ছেন তিন লাখ। এই স্টল মিলবে বিদেশি কিউই ফলের চারা।
ফল গাছের মধ্যে করমচা, কাঁঠাল, লেবু, আনারস, জাম, ডালিম, আমলকী, আমড়া, লটকন, মিষ্টি তেঁতুল, চালতা, নারকেল, পেয়ারা, সফেদা, জাম, জামরুল, পিচ, রামবুটান, ডুরিয়ান, ফিঙ্গার লেমন, ডুমুর, মরিচ, ড্রাগন, সৌদি খেজুর, চেরিসহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ফলের চারা। তবে বেশির ভাগ চারাই কলম করা।
লালবাগ থেকে এসেছিলেন সীমা নামের এক তরুণী। তিনি কিনেছেন চালতাগাছের চারা। বললেন, বাড়ির ছাদে শখের বাগান আছে। এই চালতাগাছটি তিনি এখন ছাদে লাগাবেন। পরে লাকসামে বাড়ি যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন।
ফুলের মধ্য রয়েছে মাধবীলতা, এলামেন্ডা, টগর, জবা, জুঁই, বেলি, রজনীগন্ধা, স্থলপদ্ম, হাসনাহেনা, রঙ্গন, গোলাপ, কাঠগোলাপসহ নাম না-জানা আর কত কী। কয়েকটি স্টলে দেখা মিলেছে শাপলার। মাটির বড় পাত্রে বেগুনি রঙের শাপলা। একজন কিনতে চাইলে বিক্রেতা দাম হাঁকলেন ১ হাজার ২০০ টাকা। আর কিনলেও তিনি এটি দেবেন না, দেবেন কলিযুক্ত শাপলাগাছ। কারণ, ফুটে থাকা শাপলাটি তিনি দর্শনার্থীদের জন্য রেখেছেন।
এ ছাড়া রয়েছে তেজপাতা, কারি পাতা, নিলগাছ, বাসকপাতা, এলাচি, গোলমরিচ, পোলাওপাতা, দারুচিনি, মেহেদি, অ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ধরনের ঔষধি ও মসলা গাছের চারা।
হবি অ্যান্ড নেচার নামের স্টলে শুধু গাছই নয়, বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ফুল ও সবজির বীজ। এ ছাড়াও মেলায় আছে নানান ধরনের জাপানি বট, চায়নিজ বটসহ নানা ধরনের বনসাই ও অর্কিডের জাত। আছে ইনডোর প্ল্যান্টের কয়েকটি স্টল।
গাছ পরিচর্যার জন্য আছে জৈব সার, বীজ, কীটনাশক, বাগান পরিচর্যার সরঞ্জাম, ফুলের টব এবং গাছের খাবার ভিটামিন। মিলছে গাছসংক্রান্ত বইও।
গাছ ছাড়াও হারবাল পণ্য, হ্যান্ডি ক্র্যাফট, মাটির পাত্র ও ইনডোর প্ল্যান্টের বেশ কয়েকটি স্টল আছে।
মেলায় তথ্যকেন্দ্রের দায়িত্বরত বন কর্মকর্তা রেজাউল হক খান বলেন, ৬ জুলাই বিকেল চারটা পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৪টি চারা বিক্রি হয়েছে। এর মূল্য ৪ কোটি ১৭ লাখ ৪২ হাজার ১৬১ টাকা। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, তথ্যকেন্দ্রসহ সরকারি-আধা সরকারি ১০টি স্টল আছে মেলায়। আর মোট স্টল ১০০টি।
কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, ‘এ মৌসুমটি গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাই যাঁদেরই সুযোগ আছে, তাঁদেরই উচিত গাছ লাগানো। যাঁরা ছাদে বাগান করেন, তাঁরা ফলের গাছ, শাকসবজি লাগাতে পারেন। কোনো অর্নামেন্টাল গাছও লাগাতে পারেন। আমগাছ লাগালে ছাদের জন্য আম্রপালি ভালো হবে। প্রতিদিন আমাদের ভিটামিন সি-এর চাহিদা মেটাতে ছাদে লেবু, থাই মাল্টা, হাইব্রিড জলপাই, কতবেল, বারোমাসি আমড়া, হাইব্রিড আমলকী, থাই জাম্বুরা ও থাই পেয়ারাগাছ লাগালে ভালো হবে। এ ছাড়া আমরা বাজার থেকে যে সবজি ও ফল কিনি, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়—এগুলো কেমিক্যালমুক্ত কি না। তাই একটি পরিবারের প্রয়োজনীয় সবজি ও টুকটাক ফল নিজের ছাদে করে নিতে পারলে ভালো হয়।’