ঈদুল আজহা উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় দুর্গন্ধযুক্ত যে চাল বিতরণ করা হয়েছিল, তা ছিল জীবননগর খাদ্যগুদাম থেকে পাঠানো। গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি) কাওসার আহমেদ স্থানীয় তিন মিলারের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করেছিলেন। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেজাউল ইসলাম ও কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক তা মজুত করতে সহায়তা করেছিলেন। ওই চাল সরবরাহ করেছিলেন সদর ওসি–এলএসডি আবু বকর ছিদ্দিক।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মনিরা পারভীনের নেতৃত্বে গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত দলের প্রতিবেদনে তথ্যপ্রমাণসহ দুর্গন্ধযুক্ত চাল সরবরাহের ঘটনায় ওই চারজনের জড়িত থাকার প্রমাণ এভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনায় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে গঠিত বিভাগীয় তদন্তের ভিত্তিতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ প্রথম তিনজন রক্ষা পেয়েছেন। দুর্গন্ধযুক্ত চাল কেন সরবরাহ করা হলো, সেই অভিযোগে সদর খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি আবু বকর ছিদ্দিকের ওপর সব দায় চাপানো হয়েছে। শাস্তি হিসেবে তাঁকে খুলনার মহেশ্বরপাশা কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামে বদলি করা হয়েছে।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, খুলনা আঞ্চলিক খাদ্যগুদামের রসায়নবিদ একরামুল কবিরের নেতৃত্বে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি বিভাগীয় এই তদন্ত করে। জীবননগরের ওসি–এলএসডি কাওসার আহমেদের ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কায় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একরামুলকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। একরামুল গত ৩০ জুলাই শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় আসেন। এরপর তদন্ত শেষে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। যেখানে শুধু সদর ওসি–এলএসডি আবু বকর ছিদ্দিকের কর্তব্যে অবহেলার কথা উল্লেখ করেন ওই তদন্ত কর্মকর্তা।
পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অস্বীকার করে আঞ্চলিক খাদ্যগুদামের রসায়নবিদ একরামুল জানান, ‘আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নির্দেশনা অনুযায়ী সরেজমিন তদন্ত করে যেসব তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসনের তদন্তের সঙ্গে বিভাগীয় তদন্তের পার্থক্য প্রসঙ্গে একরামুল বলেন,‘তাঁরা বড় পরিসরে তদন্ত করেছেন। আমি শুধু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে কাজ করেছি।’
বিভাগীয় এই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১২ সেপ্টেম্বর রোববারের মধ্যে সদরের ওসি-এলএসডি আবু বকর ছিদ্দিক খুলনায় ও সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের পরিদর্শক নজরুল ইসলামকে সদরের ওসি–এলএসডি হিসেবে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান ১ সেপ্টেম্বর এই বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেন। নজরুল ইসলাম ২ সেপ্টেম্বর বদলির দাপ্তরিক আদেশপত্র সরাসরি পেলেও আবু বকর ছিদ্দিক ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা হাতে পাননি।
এ বিষয়ে খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান মুঠোফোনে জানান, জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি কী পেয়েছে, তা তাঁর জানা নেই। তবে বিভাগীয় তদন্তে সদরের ওসি–এলএসডি আবু বকর ছিদ্দিকের কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
মাহবুবুর আরও বলেন, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বিষয়ে মহাপরিচালকের কার্যালয় সিদ্ধান্ত নেবে। জীবননগর ওসি–এলএসডি ও সদরের কারিগরি খাদ্য পরিদর্শকের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। তাঁদের জবাব হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভাগীয় তদন্তে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের ঘটনায় জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের তদন্তে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, দুই ওসি–এলএসডি ও কারিগরি খাদ্য পরিদর্শকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিস্তারিত বলা হয়েছে। যেখানে জীবননগরের ওসি–এলএসডি কাওসার আহমেদকে মূল অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের সবাইকেই শাস্তির আওতায় আনা হবে।
যেভাবে ঘটনার শুরু
সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৮ জুলাই ভিজিএফ কার্ডধারী ৬০০ জনের মধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত চাল বিতরণ করা হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেজাউল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ১০ হাজার ৫৬০ কেজি নিম্নমানের চাল জব্দ করেন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মনিরা পারভীনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে এ ঘটনার জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেজাউল ইসলাম, সদর ওসি–এলএসডি আবু বকর ছিদ্দিক, জীবননগর ওসি-এলএসডি কাওসার আহমেদ ও সদর উপজেলা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক মো. আনিছুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়।