গণতন্ত্র

সামাজিক ব্যবসা

মুহাম্মদ ইউনূস
মুহাম্মদ ইউনূস

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বিশ্ব অর্থনৈতিক পদ্ধতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে পুঁজির জোগান দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই গঠিত হয়েছিল ঋণবাজার ব্যবস্থাপনা। কিন্তু হালে তা গুটি কয়েক বিশাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের হাতে জুয়া খেলার আসরে পরিণত হয়েছে। পরিণতি হিসেবে উন্নত বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের গভীর গহ্বরে পড়ে গেল। ফলে উন্নয়নশীল দেশের শতকোটি মানুষের জীবনে বেকারত্বের ধাক্কা এসে লাগল। ইউরোপীয় দেশগুলোও এর থেকে রেহাই পেল না। গ্রিস, ইতালি, স্পেনে নজিরবিহীন বেকারত্ব আসন গেড়ে বসল।

বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে চলমান অনেক সামাজিক সমস্যার সরব উপস্থিতি মূলত পুঁজিবাদের ভুল প্রচলনেরই ফসল। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রকৃত লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন। আর এতে মানুষের ভূমিকা ধার্য করা হয়েছে একমাত্রিক রোবট হিসেবে, যে রোবট টাকা ছাড়া আর কিছু চেনে না।

সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি আমার মাথায় এসেছিল, কারণ আমি ব্যবসাকে চেয়েছিলাম সমস্যা সমাধানের একটি মাধ্যম হিসেবে, টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে নয়।

এই কোম্পানিগুলো, যেগুলোকে আমি ‘সামাজিক সচেতনতা দ্বারা পরিচালিত কোম্পানি’ হিসেবে অভিহিত করে এসেছিলাম, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রকৃতির অন্য ডাইমেনশনেরই প্রতিফলন। এটিকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য আমি বলতে পারি, মানুষ একই সঙ্গে স্বার্থপর ও নিঃস্বার্থপর। স্বার্থপরতা মানুষের প্রকৃতিরই একটি অংশ—এটির উৎপত্তি হয় নিজেকে সুরক্ষা করার ভাবনা থেকে। অন্যদিকে মানুষ নিঃস্বার্থপরও বটে। সুতরাং, মানুষের প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে স্বার্থপরতা ও নিঃস্বার্থপরতা উভয়টির সংমিশ্রণ। এ ছাড়া আরও অনেক ডাইমেনশনও রয়েছে মানবপ্রকৃতির মধ্যে। তত্ত্ববিদেরা, যাঁরা বর্তমান অর্থনীতির ফ্রেমওয়ার্ক ডিজাইন করেছেন, তাঁরা এতসব ডাইমেনশনের ওপর দৃষ্টি আরোপ করেননি, শুধু একটি ট্র্যাকের ওপরই দৃষ্টি দিয়ে তাঁরা কেবল একধরনের ব্যবসার ধারণাই তৈরি করেছেন। আর কোনো ধরনের ব্যবসার জায়গা করে দেওয়ার কথা তাত্ত্বিকদের মাথায় আসেনি।

মানুষের ‘নিঃস্বার্থপর’ প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করা নতুন যে ব্যবসার কনসেপ্ট আমি সৃষ্টি করেছি, তার নাম দিয়েছি ‘সামাজিক ব্যবসা’।

সামাজিক ব্যবসা নিজে মুনাফা অর্জন করে, কিন্তু মালিক মুনাফা নেয় না, শুধু মূল বিনিয়োগ ফেরত নিতে পারে। এ কোম্পানির মূল লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক বা পরিবেশগত সমস্যার সমাধান। সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা লগ্নি করা বিনিয়োগ ফেরত পাবেন। এর পর থেকে সব মুনাফা থেকে যাবে কোম্পানিতে। সেটি ব্যবহূত হবে সেবার আওতা বাড়াতে অথবা প্রদেয় পণ্য ও সেবার মান উন্নয়নে। সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীর প্রেষণাই হলো ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে বরং মহৎ কিছু করার আকাঙ্ক্ষা।

শুধু ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের তাগিদ থেকে সৃষ্ট সমষ্টিগত অসাম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ রচনা করে দিতে পারে সামাজিক ব্যবসা। এ কারণে প্রচলিত কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফামুখী ব্যবসার সমান্তরালেই গড়ে তুলতে পারে সামাজিক ব্যবসা। পাশাপাশি বিদ্যমান সামাজিক ব্যবসা বিস্তারের পথ রচনা করে দিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যক্তিগত অথবা করপোরেট কাঠামোয় অনুদান অব্যাহত থাকতে কোনো বাধা নেই। তবে এই অনুদানের রয়েছে একটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা। কারণ, দান করা পয়সার উপযোগিতাই সীমাবদ্ধ। দানের টাকা একবার ব্যবহূত হলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু সামাজিক ব্যবসায় খাটানো অর্থ অবিরতভাবে খাটানো সম্ভব। এটি পুনর্ব্যবহার করা যায় অন্তহীনভাবে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দানশীলতা-সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব তো বটেই, বরং তার চেয়ে বড় কথা, তা হবে টেকসই পদ্ধতিতে। এখানেই সামাজিক ব্যবসার সাফল্য।

এ ধরনের পরস্বার্থমুখী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার ভাবনাটি অনেকের কাছেই অবাস্তব ঠেকতে পারে। কিন্তু মানুষ যতই জানছে, ততই গ্রহণ করছে সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিকে। এরই মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটছে বাংলাদেশে। অন্যরাও গ্রহণ করছে এটি। আলবেনিয়া, হাইতি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, চীন ও জার্মানিতেও গড়ে উঠছে সামাজিক ব্যবসা। অন্যান্য দেশেও লক্ষ করা গেছে মানুষের বিপুল আগ্রহ। ৭ থেকে ৯ নভেম্বর কুয়ালালামপুরে

অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পঞ্চম বিশ্ব সামাজিক ব্যবসার শীর্ষ সম্মেলন। এতে পৃথিবীর ৫০টি দেশ থেকে প্রায় ৮০০ প্রতিনিধি অংশ নেবেন।

সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি এখন অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে এবং মানুষ এটি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করার মতো আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ‘ইউনূস সেন্টারে’ প্রতি মাসে একটি করে ‘সোশ্যাল বিজনেস ডিজাইন ল্যাব’ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি। এটি শুরু হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি থেকে এবং এ পর্যন্ত মোট আটটি ডিজাইন ল্যাব অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এটি হলো বিভিন্ন পেশা, বয়স ও আয়ের স্তর থেকে আসা মানুষের একটি সমাবেশ। তাঁরা সামাজিক ব্যবসায় আগ্রহী অথবা কৌতূহলী। সামাজিক ব্যবসার মূল ধারণা মাথায় রেখে অংশগ্রহণকারীদের সৃজনশীল ব্যবসায়িক ধারণাগুলোকে তুলে ধরার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে এই ডিজাইন ল্যাব।

‘সোশ্যাল বিজনেস ডিজাইন ল্যাব’টি বাংলাদেশে যাঁরা সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য এবং একই সঙ্গে যাঁরা তাঁদের চলমান ব্যবসাকে কিংবা অনুদাননির্ভর সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করতে চান, তাঁরা যাতে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের চিন্তাগুলো স্বচ্ছ করে নিতে পারেন, তারও সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে।

সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে বক্তব্য রাখছেন মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: নাসির আলী মামুন

এ পর্যন্ত ‘ইউনূস সেন্টারে’ মোট আটটি ডিজাইন ল্যাব অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫২টি নতুন প্রকল্প এই ল্যাবগুলোতে উপস্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করে ১২টি সামাজিক ব্যবসা বাস্তবে চালু করা হয়েছে। প্রতিটি উপস্থাপিত প্রকল্পের জন্য একজন করে ‘প্রকল্পবন্ধু’ নির্বাচন করা হয়, যিনি সার্বিকভাবে এটিকে নির্দেশনা দেবেন ও ফলোআপের মাধ্যমে এর মূল্যায়ন করবেন। ডিজাইন ল্যাব থেকে নির্বাচিত প্রকল্পগুলোর যেগুলো ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হচ্ছে, পরবর্তী ল্যাবে সেগুলোর আপডেট ও ফলোআপ করে সেগুলোর সার্বিক মূল্যায়নও করা যাচ্ছে। একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, এতে অনেক তরুণ ও নবীন উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে, যাঁরা এই সামাজিক ব্যবসায় খুবই আগ্রহী এবং একই সঙ্গে অনেক বিনিয়োগকারী এবং সামাজিক ব্যবসার উদ্যোক্তাও পাওয়া যাচ্ছে—এটিই ডিজাইন ল্যাবের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।

আজকের পৃথিবী যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, তা সমাধান করার জন্য আমাদের যা করতে হবে, তা হলো সঠিক কনসেপচুয়াল ও ইনস্টিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা, যাতে আমাদের সবার মধ্যে যে সৃজনশীল প্রতিভা সুপ্ত রয়েছে, তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

আমি বিশ্বাস করি, আমরা এমন একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে সক্ষম, যেখানে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মতো বড় সামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে অন্যান্য সামাজিক সমস্যা আর থাকবে না। মানুষের নিজের দোষে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টি হয় না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টির বড় কারণ আমাদের তাত্ত্বিক কাঠামোতে বিরাট গলদ। এই গলদ সংশোধনের উদ্যোগ আমাদের অবশ্যই নিতে হবে।

পুঁজিবাদের বর্তমান বিরাট সংকটকালটি এ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য উত্তম সময় এবং এই সুযোগ হারানো মোটেই আমাদের উচিত হবে না।

মুহাম্মদ ইউনূস: শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ; গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা