শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বিজয় দিবস উদযাপন

হাতে হাতে পতাকা, মুখে মুখে স্লোগান

হাতে লাল-সবুজের পতাকা। অনুভবে দেশাত্মবোধ। গতকাল বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল l ছবি: প্রথম আলো
হাতে লাল-সবুজের পতাকা। অনুভবে দেশাত্মবোধ। গতকাল বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল l ছবি: প্রথম আলো

বাবা-মায়ের কোলে চড়ে, হাত ধরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসেছিল হাজারো শিশু। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অর্থ বোঝার বয়স তাদের হয়নি। বাবা-মা ও স্বজনদের সঙ্গে আধো আধো বোলে তারাও স্লোগান দিচ্ছিল ‘জয় বাংলা’। ছোট-বড় প্রায় সবার হাতেই ছিল বাংলাদেশের পতাকা। মাথায় বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড।
মহান বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গতকাল সারা দিনই ছিল জনতার ঢল। হাজারো জনতার খণ্ড খণ্ড মিছিল থেকে ভেসে আসছিল নানা স্লোগান। ‘বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই নাই’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘জামায়াত নিষিদ্ধ করো’ স্লোগানে মুখরিত ছিল সাভারের স্মৃতিসৌধ এলাকা।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিজয়ের ৪৩ বছর উদ্যাপন করতে আসা হাজারো মানুষের মধ্যে ছিল বাঁধভাঙা উল্লাস। তবে এর মধ্যেও ৩০ লাখ শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে ভোলেননি তাঁরা। অনেককেই দেখা গেছে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে। শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে তাঁদের হাতে ছিল নানা রঙের, নানা বর্ণের ফুল। অনেকেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নীরবতা পালন করেছেন। বিজয় দিবস উদ্যাপনের এমন চিত্র কেবল জাতীয় স্মৃতিসৌধ বা এর আশপাশের এলাকার মধ্যে সীমিত ছিল না। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ বিজয় দিবসে স্মরণ করেছেন ৩০ লাখ শহীদ আর সভ্রম হারানো মা-বোনকে।
দিনটি উপলক্ষে প্রায় সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল আলোচনা সভা, সেমিনার, শোভাযাত্রা, সাইকেল শোভাযাত্রা, স্কেটিং, নৌকাবাইচ প্রভৃতি। সাধারণ মানুষও ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভিড় করেন। এখানেই পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল। এ ছাড়া সংসদ ভবন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দিনভর সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। পরিবার-পরিজন নিয়ে এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখতে আসেন তাঁরা।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ: সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিবসের কর্মসূচি। তাঁরা শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং সেখানে নীরবতা পালন করেন। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, তিন বাহিনীর প্রধানেরা সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তাঁরা জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করেন। এরপর স্মৃতিসৌধ সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিসৌধ এলাকায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পক্ষে ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্মৃতিসৌধে আসেন বেলা সাড়ে নয়টায়। এ সময় তাঁর সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় ও সাভার থানার নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক লেবার পার্টিকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।
আশুলিয়ার বাইপাইল থেকে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসেন জয়নাল আবেদিন। এবার চার বছর পর এখানে এলেন। বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের ইতিহাস জানাতে হবে। দেশটা যে সহজে আমাদের হয়নি, তা বোঝানো দরকার। তা না হলে ভালোবাসা আসবে কোথা থেকে!’ তাঁর সঙ্গে আসা তিন ছেলেমেয়ের মুখে পতাকা ও স্মৃতিসৌধের ছবি আঁকা। মাথায় ব্যান্ড আর হাতে ছোট পতাকা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকাল থেকে সাধারণ মানুষের ভিড় শুরু হয়। সেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গান পরিবেশন করেছে। আর বিকেলে বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের কর্মসূচি পালন শুরু করে। সেখানে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, বিজয় দিবস উদ্যাপন জাতীয় কমিটি কর্মসূচি পালন করে। জাতীয় কমিটির কর্মসূচিতে বিকেল চারটা ৩১ মিনিটে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। এতে ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের শত শত কর্মী অংশ নেন।
উদ্যানের কাছে শাহবাগে নানা কর্মসূচি পালন করে গণজাগরণ মঞ্চের আরেকটি অংশ। কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন এই অংশ সেখানে নাটক, গান পরিবেশন করে। এই এলাকায় ট্রাকে করে কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করে।
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড: জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর সশস্ত্রÊবাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে সেখানে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। সাধারণ মানুষও মনোমুগ্ধকর এই কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর বাদক দলের সদস্যরা নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অবস্থান করে দেশাত্মবোধক গানের সুর তোলেন।
দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজসহ বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।­