
হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দমে যাননি। আট লাখ টাকায় আসামিরা আপস করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি টাকা নেননি। হুমকি-ধমকি, টাকার লোভ উপেক্ষা করে বিচারের আশায় অটল ছিলেন রাজধানীর শাহজাহানপুরে পরিত্যক্ত পাইপে পড়ে নিহত শিশু জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিন। নাসির রাজধানীর একটি সরকারি স্কুলের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেন।
২৬ মাস আগে তাঁর তিন বছরের ছোট্ট শিশু জিহাদ রেলওয়ের পরিত্যক্ত গভীর পাইপে পড়ে মারা যায়। এ ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। যাঁদের অবহেলার কারণে পাইপের মুখটি খোলা ছিল, তাঁদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তিন সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলের মৃত্যুর পর মামলা করেন নাসির উদ্দিন।
আজ ঢাকার একটি আদালত শিশু জিহাদের মৃত্যুর অবহেলার জন্য দায়ী করে একজন ঠিকাদার, রেলওয়ের দুজন প্রকৌশলীসহ চারজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে খালাস পেয়েছেন রেলওয়ের আরও দুজন প্রকৌশলী। আসামিদের কারাদণ্ডের রায়ে আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন, এঁদের অবহেলায় তিন বছরের ছোট্ট শিশু জিহাদ মারা গেছে। এর শাস্তি তাঁদের ভোগ করতে হবে।
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিকেল চারটার দিকে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বাসার পাশে পরিত্যক্ত পানির পাম্পের কাছে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে পাম্পের একটি পরিত্যক্ত দেড় ফুট ব্যাসের গভীর পাইপে পড়ে যায় জিহাদ। ফায়ার সার্ভিস দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানেও জিহাদকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরদিন বেলা তিনটার দিকে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে। এরপর একদল উদ্যমী তরুণের চেষ্টায় শিশু জিহাদের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা অফিসার। তাঁদের অনেক টাকা। মামলার পর লোক পাঠিয়ে হত্যার হুমকি, জোর করে স্ট্যাম্পে সই নেওয়া, টাকার লোভ দেখানোসহ সব ধরনের চেষ্টাই আসামিরা করেছেন। কিন্তু ছেলের বিচারের জন্য কোনো হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও আপস করেননি। চারজন আসামির সাজা হওয়ায় ভয় লাগে কখন তাঁরা কী করে বসেন।
নাসির জানালেন, গত বছরের ৪ অক্টোবর বিচার শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে অজ্ঞাত তিনজন ব্যক্তি তাঁর বাসায় আসেন। তাঁরা না বসে দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁকে বলেন, ‘ভাইদের সাজা হলে তুই বাঁচতে পারবি না।’ তাঁকে কেবল হুমকি দেওয়া হয়নি, জোরপূর্বক সাদা স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষরও করিয়ে নিয়েছেন আসামিরা।
শিশু জিহাদের মামলার রায় ঘোষণার পর ঠিকাদার আবদুস সালাম ও প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছিলেন, তাঁরা কোনো অন্যায় করেননি। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাননি। উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিন জানালেন, মামলার পর অন্তত দফায় দফায় ছয়জন আসামি তাঁর শাহজাহানপুরের বাসায় গেছেন। বারবার তাঁরা বলতে চেয়েছেন, ছেলেকে তো আর ফিরে পাবেন না। তাই টাকাপয়সা নিয়ে মামলা উঠিয়ে নিলেই ভালো হয়। কিন্তু নাসির রাজি না হলে তাঁর বাসায় লোক পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছেন। এ ঘটনায় নাসির উদ্দিন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বলে জানান তাঁর আইনজীবী জসীম উদ্দিন খান।
আইনজীবী জসীম বলেন, মামলার বিচার শুরুর পর শাহজাহানপুরের স্থানীয় একজন কমিশনারের কার্যালয়ে নাসিরকে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক তাঁর কাছ থেকে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন আসামিরা।
নাসিরের হত্যার হুমকি পাওয়ার জিডি করা প্রসঙ্গে শাহজাহানপুর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। তাই বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
বাধাবিপত্তির পরেও অবিচল থাকার ব্যাপারে নাসির বললেন, শাহজাহানপুরের রেলওয়ের যে নলকূপে জেহাদ পড়ে গিয়েছিল, তা খোলা ছিল বহুদিন ধরেই। রেলের লোকজনদের বারবার বলা হয়েছিল, পাইপের মুখটা যেন আটকে দেয়। কিন্তু রেলের লোকজন বলত, যার যার বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখতে। এঁদের কারণে জিহাদের মৃত্যু। তাই তাঁদের শাস্তিই চেয়েছিলাম। চারজনের সাজা হয়েছে। কিন্তু দুজন খালাস পেয়ে গেছেন। তাঁদের খালাস স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান নাসির।
আজ রায় ঘোষণার সময় জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিনকে কাঁদতে দেখা যায়। রায় ঘোষণার পর আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাসির বলছিলেন, জিহাদের কথা তাঁর খুব মনে পড়ছে। জিহাদের মৃত্যুর মাত্র এক ঘণ্টা আগে তাঁর মুখে ভাত তুলে দেন তিনি।
নাসিরের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সবার ছোট ছিল জিহাদ। বাবা নাসিরের চোখে জিহাদ ছিল অন্য রকম। নাসির বললেন, ‘জিহাদের ব্রেন ভালো ছিল। যেকোনো জিনিস মনে রাখতে পারত। ওকে আমি জজ বানাতে চেয়েছিলাম।’
জিহাদের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর মা খাদিজা অসুস্থ। জিহাদের কথা মনে করেই প্রায় বিলাপ করেন তিনি। নাসির বললেন, ‘জিহাদ পাঁচ টাকা নিত তাঁর মায়ের কাছ থেকে। পাঁচ টাকার নোট ছিল তাঁর খুব প্রিয়।’
ছোট্ট জিহাদ ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসত। তাই তাঁর বাবা ছোট্ট একটি ব্যাট বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিনে দিয়েছিলেন বল। প্রায় প্রতিদিনই জিহাদকে নিয়ে শাহজাহানপুরের রেলওয়ের কলোনির খেলার মাঠে ক্রিকেট খেলতেন। জিহাদের বড় ভাই জিসানও খেলত।
যখন শিশুরা রেলওয়ের খেলার মাঠে ক্রিকেট খেলে, তখন নাসিরের জেহাদের কথা খুব মনে পড়ে। মৃত্যুর পর থেকে প্রতিদিনই তাঁর মনে হয়, রেলের লোক যদি নলকূপের মুখ ঢেকে দিত, তাহলে তাঁর জিহাদ আজ সব শিশুর সঙ্গে রোজ ক্রিকেট খেলত।