
ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে—এমন অন্তত ১১১টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আগুন দিয়েছে নির্বাচনবিরোধীরা।
রাতে ঠাকুরগাঁওয়ে একটি ভোটকেন্দ্রে হামলার পর কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে।
ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার ধরন দেখে পুলিশ ধারণা করছে, নির্বাচন প্রতিহত করতে পরিকল্পিতভাবে দেশের কয়েকটি জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বেছে নেওয়া হয়েছে।
একতরফা এই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৮ হাজার ২০৮ এবং ভোটকক্ষের সংখ্যা ৯১ হাজার ২১৩টি।
১৮-দলীয় জোটের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত শুক্রবার রাতে বিবৃতি দিয়ে ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছেন।
গতকাল শনিবার লন্ডন থেকে পাঠানো এক ভিডিওবার্তায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচন প্রতিহত করার এবং ভোট বর্জনের আন্দোলনে নেতা-কর্মীদের বিভেদ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয়, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ৩২টি জেলার ১১১টি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় আগুন দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার পরপরই স্থানীয় লোকজন নিভিয়ে ফেলায় সেগুলো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। দরজা-জানালা পুড়েছে ২৩টির, আসবাব পুড়েছে ৪৬টি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের। অন্তত ১২টি স্কুলে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়।
দেশজুড়ে এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটলেও কেবল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় আরিফ হোসেন (২২) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। ওই যুবক শিবিরের কর্মী বলে জানিয়েছে পুলিশ। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগুন নেভাতে এগিয়ে যান এলাকাবাসী। তবে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগুন নেভাতে দমকল বাহিনীকে ছুটতে হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরসহ বিএনপি জোট নির্বাচন ঠেকানোর নামে পেট্রল ও গান পাউডার দিয়ে দেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। গতকাল দুপুরে নিজ বাসভবনে আয়োজিত জরুরি ব্রিফিংয়ে তিনি প্রায় ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ভোটকেন্দ্র এক দিনের জন্য, কিন্তু স্কুল-কলেজ চিরদিন থাকবে। স্কুল-কলেজের আশপাশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ এলাকাবাসীকে অশুভ শক্তির হাত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা মোহাম্মদিয়া খাইরিয়া মাদ্রাসা, ছদাহা আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা ও আজিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দিয়েছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তাঁরা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করেছেন। আনসার সদস্যের একটি অস্ত্র ও নির্বাচনী সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে যান।
কুমিল্লার লাকসাম, মুরাদনগর ও বুড়িচং উপজেলার ১০টি ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রলবোমা হামলা হয়েছে। শুক্রবার রাত ও গতকাল ভোরে এসব ঘটনা ঘটে। পেট্রলবোমা হামলায় বুড়িচং উপজেলার সাদেকপুর ইসলামিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা কেন্দ্রের একটি কক্ষ পুড়ে যায়।
লাকসামে আটটি ভোটকেন্দ্রে শুক্রবার ভোররাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এগুলো হচ্ছে: আতাকরা উচ্চবিদ্যালয়, পৌর এলাকার ধামৈচা, বাতাখালী, কোমারডোগা, মুদাফরগঞ্জ ইউনিয়নের পাশাপুর, চিকুনিয়া ও আউশপাড়া এবং সালেপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে পুলিশ তিনটি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
মুরাদনগর উপজেলার বোরারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের নির্বাচনী সরঞ্জামে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়টির তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর দুটি কক্ষ পুড়ে গেছে। ভস্মীভূত হয়েছে কিছু নতুন বই।
সুনামগঞ্জের তিনটি ভোটকেন্দ্রে গতকাল ভোরের দিকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ধরমপাশা উপজেলার গড়াকাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষের বেঞ্চে এবং একই উপজেলার সরিশামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের বারান্দায় খড় জড়ো করে আগুন দেওয়া হয়। দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের রামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আগুন দেওয়ায় কয়েকটি বেঞ্চ ও কিছু বই পুড়ে গেছে।
বরগুনায় সাতটি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়। জেলা সদরের দক্ষিণ লেমুয়া, মধ্য পাঠাকাটা, কে লতাবাড়িয়া, নলী-মাইঠা ও আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং বেতাগী উপজেলার রানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। এতে পাঠাকাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। বাকি পাঁচটি বিদ্যালয়ের বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায়। আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গতকাল ভোররাতে দেওয়া আগুনে ভবন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় শুক্রবার গভীর রাতে দেওয়া আগুনে তুবাং প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কক্ষের দরজা, জানালা ও আসবাব পুড়ে যায়। জৈন্তাপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের একটি গুদামঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় শুক্রবার রাতে গুজাদিয়া (২), নয়াকান্দি ও গাংগাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা করা হয়।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ছলিমগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি দরজা পুড়ে যায়।
নেত্রকোনার চারটি ভোটকেন্দ্রে শুক্রবার রাতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মদনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন লাগানো মাত্রই স্থানীয় লোকজন এসে নিভিয়ে ফেলেন। কলমাকান্দা উপজেলার জনতা উচ্চবিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী দুটি বাড়ির খড়ের গাদায়ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
আগুন দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল সদরের ঢেলি করটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এইচ এম ইনস্টিটিউট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং গোপালপুর উপজেলার মাহমুদপুর উচ্চবিদ্যালয় ও পরশিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
রাজশাহীর চারঘাটের চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুক্রবার রাতে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সারদা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের অফিসকক্ষের দরজা ও জানালার পর্দা পুড়ে গেছে। কালাবিপাড়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের চারটি কক্ষের চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চসহ টিনের চালা পুড়েছে। শলুয়া ডিগ্রি কলেজের একটি কক্ষের দরজা ও ভেতরে আসবাব পুড়েছে। সারদা উচ্চবিদ্যালয়ের চারটি কক্ষে দেওয়া আগুনে টেবিল, চেয়ার ও বেঞ্চ পুড়ে গেছে।
পটুয়াখালীর নন্দীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি শুক্রবার রাতে আগুন দিয়ে পোড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বটতলী মাদ্রাসা, বারবিসা ও চিকন মাটি ভাদুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দরজার সামনে খড় দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এলাকাবাসী দ্রুতই আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার ক্ষিদ্রবড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। এতে দুটি কক্ষের দরজা-জানালা পুড়ে গেছে।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার দেবীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রসংলগ্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত একটি ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। ঘরটির দুটি দরজা পুড়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ ও রামগতি উপজেলার সাতটি ভোটকেন্দ্রে দুর্বৃত্তরা শুক্রবার গভীর রাতে আগুন দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে: মধ্য সোনাপুর, কাউলীভাংগা, সুন্দরা, রসুলপুর, শাহজকী ও বদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আগেই এলাকাবাসী আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের খামার হাসনাবাদ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিলে আসবাব পুড়ে যায়।
ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ললিত মোহন ভূঁইয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পেট্রল দিয়ে আগুন লাগালে চেয়ার, বেঞ্চ, টেবিল, বুথের চাটাইসহ অন্যান্য আসবাব পুড়ে যায়।
গাইবান্ধার পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে। তিনদহ প্রাথমিক বিদ্যালয় অফিসকক্ষে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারলে দরজা-জানালা পুড়ে যায়। সুলতানগঞ্জ, মহেশপুর ও বিশ্রামগাছি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়েছে। আশপাশের লোকজন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। বিশ্রামগাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক জোড়া বেঞ্চ পুড়ে গেছে।
শুক্রবার রাতে ও গতকাল সকালে যশোরের মনিরামপুরের সাতটি ভোটকেন্দ্রে পেট্রলবোমা ও ককটেল হামলা হয়েছে। কেন্দ্রগুলো হলো: বিজয়রামপুর, তাহেরপুর ও পাড়িয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; পোড়াডাঙ্গা, ডাঙ্গামহিষদিয়া, খেদাপাড়া ও লাউড়ী ষষ্ঠীতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আগুন দেওয়া হয়েছে যশোরের বাঘারপাড়ার কয়েলখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
দিনাজপুরে গতকাল বড়ইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। এতে অফিসকক্ষের আসবাব ও কাগজপত্র পুড়ে গেছে। চাঁদগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হলেও তেমন ক্ষতি হয়নি। শহরের তফিউদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে অগ্নিসংযোগ করার চেষ্টা হয়েছে। পার্বতীপুর উপজেলার হয়বতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি কক্ষের আসবাব পুড়ে যায়।
খুলনার বি কে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউট বিদ্যালয়, রূপসা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়, সুন্দরবন সরকারি আদর্শ কলেজ ও নজরুলনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। বি কে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউটে বেশ কিছু নতুন বই পুড়ে গেছে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পুবাইল আদর্শ রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। চারটি কক্ষের কয়েকটি দরজা পুড়ে গেছে। ত্রিশাল উপজেলার কানিহারী ইউনিয়নের বাঘাদারিয়া দাখিল মাদ্রাসার কয়েকটি বেঞ্চে আগুন দেওয়া হয়। কেন্দ্রের একটি টিনশেড ঘরের কিছু অংশ পুড়ে যায়। গফরগাঁওয়ের আস্কার আলী উচ্চবিদ্যালয় ও ছফির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলায় খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।