১.
‘গাড়িটা তোমাদের জন্য ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমার মতো।’
লকডাউনের এই অবসরে ঈদের কয়েকটা নাটক দেখছিলাম। এই সংলাপটিও এমনই একটি নাটকের অংশ। এ বছরের ঈদের নাটকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক সংলাপ বোধ হয় এটিই। এই সংলাপের প্রেক্ষাপট বুঝতে আমাদের আরেকটু পেছনে ফিরতে হবে। মিজানুর রহমান আরিয়ান এ সময়ের দারুণ একজন নির্মাতা, বেশ কিছুকাল সময় ধরেই তিনি চমৎকার সব কাজ করে যাচ্ছেন। তবে ‘উপহার’ নাটকটি বোধ করি তাঁর অন্য সব কাজের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকবে।
নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র সোহান সাহেব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সাধারণ বাঙালি পরিবারের মতো স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত জীবন তার। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি ও তার স্ত্রী আবিষ্কার করলেন, কে বা কারা তাদের বাসার সামনে একটি গাড়ি রেখে গেছেন। গাড়ির কাগজপত্রে সোহান সাহেবের নাম লেখা, যেন কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী অগোচরে এসে গাড়িটি উপহার দিয়ে গেছেন। শুরুতে অবাক এবং কিছুটা খুশি হলেও দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি নিয়ে সোহান সাহেবের বিপত্তি বাড়তে থাকে। গাড়ির জন্য চালক রাখা, গ্যারেজ ভাড়া, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগাতে তার হিমশিম অবস্থা। এর মধ্যে আবার অফিসে বেধে যায় আরেক কাণ্ড। সোহান সাহেবের দায়িত্বে থাকা ৩৫ লাখ টাকার হিসেবে গরমিল ধরা পড়ে। যদিও এটি ছিল সোহান সাহেবের অনিচ্ছাকৃত ভুল, কিন্তু নতুন গাড়িতে করে অফিসে যাতায়াত, চালক রাখা সবকিছু দেখে সোহানের বস সন্দেহ করেন এ টাকা সোহান সাহেবই সরিয়েছেন। যার ফলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, সঙ্গে পুরো টাকা ফেরত না দিলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। এ অবস্থায় সোহান সাহেব দোটানায় পড়ে যান। তার হাতে একটিই উপায়, নিজেকে বাঁচাতে হলে গাড়ি বিক্রি করে অফিসে টাকা শোধ করতে হবে। কিন্তু গাড়ির মায়াও তিনি ছাড়তে পারছেন না। এ সময় সোহান সাহেব তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান, পুরো নাটকে এই প্রথম তার বাবার প্রসঙ্গ সামনে আসে। গাড়ি নিয়ে দূরের একটি শহরে সোহান সাহেব তার স্ত্রীসহ বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান৷ ছেলে আসবে বলে বাবা খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষে সোহান তার বাবাকে তার সমস্যার কথা বলেন। সোহানের বাবা জানান, গাড়িটি তিনিই উপহার দিয়েছেন, জমি বিক্রির টাকায়। যাতে তার ছেলের অফিসে যেতে কষ্ট না হয়। আক্ষেপ করে সোহানের বাবা বললেন, ‘গাড়িটা তোমাদের দিয়েছিলাম যাতায়াতের সুবিধার জন্য, কিন্তু এখন দেখছি গাড়িটা তোমাদের জন্য ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমার মতো।’ এই কথাটির মাঝে যেন এক ক্লান্ত পিতার হাজারো অশ্রুবাষ্প লুকিয়ে আছে। সোহানের বাবার পরবর্তী কথাটি ছিল, ‘এত ঝামেলার পরও গাড়িটা তোমরা ছাড়োনি, রেখে দিয়েছ। কিন্তু বাবা তো তোমাদের জন্য এত ঝামেলার ছিল না।’
শেষমেশ নাটকটির একটি সুখী পরিসমাপ্তি ঘটলেও, এর জমানো বার্তা আমাদের চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। অশ্রুসজল পিতার এক একটা শব্দ আমাদের সমাজের মুখে এক একটি চপেটাঘাতের মতো আঘাত হানে। অতি সাধারণ এই নাটকটি সমাজকাঠামোর দিকে বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।
২.
নাটকটির সর্বশেষ দৃশ্যায়নে একটি শব্দ চোখে পড়ে, পুরো নাটকে যার উপস্থিতি ছিল না, শব্দটি ‘বৃদ্ধাশ্রম’। এটি নিছকই একটি শব্দ নয়, বলা যায়, বর্তমান সময়ে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো এক ধরনের নতুন সামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ওল্ড হোম বা বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা বেশ জনপ্রিয় ও প্রচলিত হলেও আদৌ এটি কোনো সামাজিক সুফল বয়ে আনে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ এখনো বিদ্যমান। উনিশ শতকের শেষ ভাগে, ১৮৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লেভল্যান্ড শহরে তৈরি হয় আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বপ্রথম ‘ওল্ড এজ হোম’। এর পরে অক্ষম, বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত ও একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা পেরোনো মানুষদের জন্য আলাদা বসতি স্থাপনের একটি অমানবিক রেওয়াজ চালু হতে থাকে। ধীরে ধীরে যেটি প্রসার লাভ করে উচ্চহারে। বিশ শতকেই ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ক্রমাগত জীবনযাত্রার উন্নতি, মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন এই প্রবণতাকে আরও বৃদ্ধি করে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণের ফলাফল হিসেবে উপমহাদেশেও বৃদ্ধাশ্রমের প্রচলন শুরু হয়। গত কয়েক দশকেই সেটি মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়তে থাকে৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৃদ্ধাশ্রমে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সবাই যে বিত্তহীন বা স্বজনহারা, তা কিন্তু নয়। বরং সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তথাকথিত উচ্চশ্রেণির অনেক মানুষও তাঁদের বাবা–মাকে ফেলে এসেছেন বৃদ্ধাশ্রম নামের এই নির্জন কুঠুরিতে।
সংগঠন করার সুবাদে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ একসময় সরকারি চাকরি করেছেন, কারও ব্যবসা ছিল দেশব্যাপী, কেউ-বা ওকালতি করেছেন জজকোর্টে, আবার শ্রমজীবী মানুষও রয়েছেন।
এক বাবার সঙ্গে কথা হলো, তাঁর এক সন্তান ডাক্তার, আরেক সন্তান আছেন সরকারি চাকরিতে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে তিনি সন্তানদের ‘মানুষ’ করেছেন। অথচ সেই সন্তানেরাই রাতের অগোচরে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে গেছেন। তিন বছর ধরে তিনি এখানে আছেন, দুই ছেলের কেউ তাঁকে একবারের জন্যও দেখতে আসেনি। বৃদ্ধ বাবা ছলছল চোখে বললেন, এখানে আসার দিনই তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এখন শুধু শরীরটাই আছে বেঁচে। এই দীর্ঘশ্বাস যেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি বাবার, প্রতিটি জন্মদাত্রী জননীর। যে বয়সে তাঁদের অখণ্ড অবসরে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ছিল, বিগত জীবনের স্মৃতি হাতড়ে বাকিটা জীবন পার করার কথা ছিল, সেই বয়সে তাঁরা জীবনযাপন করছেন অসহায় মানুষের মতো। বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট কক্ষে একসঙ্গে বাস করছেন আরও কয়েকজন জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তাঁদের এই মানবেতর জীবনের বেদনা সন্তানদের হৃদয় অবধি পৌঁছে না। যে বাবা-মা হাজারো দিন, হাজারো বিনিদ্র রাত পরিশ্রম করে সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, শেষে বয়সে তাঁদের ছুড়ে ফেলতে এতটুকুও কি কষ্ট হয়নি তাঁদের?
৩.
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পৃথিবীজুড়ে বাবা দিবস পালিত হয়। বাবার প্রতি ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি দিনকেই বেছে নেওয়া উচিত কি উচিত না, সে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে পারে, তবে আমাদের বোঝার চেষ্টা করা উচিত এই দিবসটি আসলে আমাদের কিসের বার্তা দেয়। প্রতিবছর বাবা দিবস বা মা দিবস আসলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বাবা-মার সঙ্গে ছবি আপলোড দেওয়ার ব্যাপকতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের নিয়মিত কিছু কাজের মধ্যে এটি অন্যতম। একজন সন্তান তার বাবা-মাকে ভালোবেসে এ দিনটিতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে ছবি দিতেই পারেন, তবে এই ভালোবাসা যেন লোক–দেখানো না হয়। লোক–দেখানো ভালোবাসা কিংবা বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা না থাকার পরিণতি কী রকম সেটি আমরা ‘উপহার’ নাটকে এবং বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর চোখে দেখেছি। আমরা চাই আর কোনো বাবা-মাকে যেন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না হয়। ফেসবুকে ছবি দিয়ে, কেক কেটে বাবাকে, মাকে ভালোবাসা না জানিয়ে যেন আমরা সত্যিকার অর্থে বাবা-মাকে ভালোবাসতে শিখি। এই দিবসগুলো মূলত আমাদের এই শিক্ষাগুলোই দিয়ে থাকে, কিন্তু আমরা সেটি নিতে পারি না। বৃদ্ধাশ্রমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যে সন্তান হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার, সমাজের জন্য লজ্জার সেটি অনুধাবন করার মতো শক্তি অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার যেন পরিবার থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজকে শপথ নিতে হবে আমাদের দেশে যেন একটিও বৃদ্ধাশ্রম না থাকে। আমাদের বাবা-মায়েদের জীবনের এই শেষ সময়টুকু নিশ্চিন্ত অবসরে কাটুক, তাঁদের দিনগুলো পার হোক নতুন প্রজন্মের সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঝুলি বিনিময়ের মাধ্যমে। জীবনসায়াহ্নে এসে যেন হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসের বিশাল বোঝা তাঁদের ওপর এসে না পড়ে—বাবা দিবসে এই হোক সবার প্রত্যাশা। বাবা দিবস শুধু মুখের কথা কিংবা ফেসবুক স্ট্যাটাসে নয়, বাবা দিবস পালিত হোক কাজের মাধ্যমে, পালিত হোক ভালোবাসায়।
* শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ishrakf1971@gmail.com