‘নারী দিবস কী কইতে পারি না। হ্যার ইতিয়াসও জানি না।’ ‘এইডা হইলো মহিলাগো অনুষ্ঠান। পোলারা জাইন্যা কী করবে।’ ‘নারী দিবসের ইতিহাস জানি না। তবে দিবসটি আমাদের দেশে পালিত হয়।’
নারীর অধিকার আদায়ের লড়াই ও মর্যাদার দিনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে এমন সব উত্তরই আসতে থাকে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে কতজন পুরুষ ধারণা রাখেন, কতজন শুধু এর ইতিহাস জানেন, সেটা খুঁজতেই গত এক সপ্তাহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-বয়সের ৪৩ জন পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই জানেন না নারী দিবস কী? ব্যতিক্রম যে একেবারেই নেই, তা নয়। কয়েকজন দিবসটির কথা শুনেছেন। তবে এ দিবসের পেছনের মর্যাদার ইতিহাসটি জানা নেই তাঁদের। মাত্র দুজনকে পাওয়া গেছে, যাঁরা এর ইতিহাস জানেন।
নারী দিবস কী, জানতে চেয়ে কথা হয় ফল বিক্রেতা মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে। ১৫ বছর ধরে তিনি রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ফল বিক্রি করেন। ঝটপট উত্তর দিলেন, ‘নারী দিবস কী কইতে পারি না। হ্যার ইতিয়াসও জানি না। তয় বচ্ছরের এই সময়ডাতে মহিলারা অনেক মানববন্ধন করে, র্যালি করে।’
পেঁপের টুকরো ক্রেতার হাতে তুলে দিতে দিতে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের জাহাঙ্গীর বলেন,‘এইডা হইলো মহিলাগো অনুষ্ঠান। পোলারা জাইন্যা কী করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের স্নাতকোত্তরের এক ছাত্র দিবসটি সম্পর্কে বলেন, ‘এটা আসলে আমার ভালো করে জানা নেই। অনেক আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, মনে নেই।’ ছাত্রটি আরও বলেন, ‘ক্লাসে শব্দটি অনেক এসেছে, তবে শিক্ষকেরা কখনো এর ইতিহাস বর্ণনা করেননি।’ নারী দিবসের ইতিহাস জানা নেই বলে নিজের নামটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান তিনি।
এক হাতে সবজি, অন্য হাতে সন্তানের জন্য খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ছাত্তার হোসেন। তিনি সেগুনবাগিচার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘নারীদের অধিকার আদায়ে দিনটি পালন করা হয়। তবে পুরো ঘটনা ভুলে গেছি।’ তবে এর জন্য তাঁকে আফসোস করতে দেখা যায়। দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘরে মা, স্ত্রী, কন্যা আছে। তাঁদের জন্য হলেও বিষয়টি আমার জানা উচিত।’ আজই বাসায় ফিরে ইতিহাসে চোখ বুলাবেন জানিয়ে রিকশায় চেপে বসেন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ছাত্তার হোসেন।
শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন ৪৫ বছরের আবদুল হাশিম। তিনি রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ে পড়ান। খুব সুন্দরভাবে বললেন নারী দিবসের ইতিহাস, ব্যাখ্যা করলেন তাৎপর্য। তিনি আরও বললেন, ‘আমরা ঘটা করে দিবস পালন করি। কোন দিবসে কোন রঙের কাপড় পরতে হয়, তা-ও জানি। অথচ দিবসটির ইতিহাস জানি না। এমনকি জানার প্রতি আগ্রহও নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র বলেন, ‘নারী দিবসের ইতিহাস জানি না। তবে দিবসটি আমাদের দেশে পালিত হয়।’ কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘দিবসটি সম্পর্কে আমি নিজেও জানব, বন্ধুদেরও জানতে বলব।’
মো. মাহতাবুল হক চার বছর ধরে বিআরটিসির মহিলা বাসে চালক হিসেবে কাজ করছেন। নারী দিবস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই দিবসের কতা তো শুনি নাই আফা।’ এরপর এই প্রতিবেদকের কাছে উল্টো জানতে চান, ‘নারী দিবস কবে? এই দিন কী হয়?’ নারী দিবসের প্রেক্ষাপট শোনার পরে শেরপুরের এই চালক বলেন, ‘তাইলে তো দিনডার গুরুত্ব আছে।’
রাজধানীর একটি বিপণিবিতানে পাঞ্জাবি কিনছিলেন তরুণ আইনজীবী সাঈদ এম তারেক। নারী দিবসের প্রেক্ষাপট তাঁর জানা। তবে সেটা নিজের আগ্রহেই। তিনি বলেন, ‘আমরা নারীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু নারীদের অর্জন, সফলতা ও সংগ্রামের কাহিনির প্রচার নেই। সচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ বিষয়ে লিফলেট প্রকাশ হওয়া দরকার।’
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে রেস্তোরাঁর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন জাফর হোসেন। বিল পরিশোধ করে সামনে আসতেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। একটু উচ্চ স্বরেই তিনি বলেন, ‘নারী দিবস আছে, পুরুষ দিবস নাই কেন বলতে পারেন?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলেন, ‘বছরের ৩৬৪ দিন পুরুষের আর একটা দিন নারীর। সব দিবসের পেছনে আছে অবহেলার ইতিহাস। যেদিন আলাদা করে নারীদের দিবস পালন করতে হবে না, সেদিন নারীর অবদান স্বীকৃতি পাবে।’
প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। মালিকপক্ষ সেই মিছিলে দমনপীড়ন চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এর আয়োজন করেন নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। দিবসটি প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানিতে ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সালে পালন শুরু হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো পালন করা শুরু করে।
জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে দিনটি নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিনটি উদ্যাপিত হয়।