
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত (বিএলআরআই) ডিমপাড়া মুরগির জাত ‘শুভ্রা’ মাঠপর্যায়ে নেই। তবে সরকারের ‘সাফল্য ও অর্জনে’র তালিকায় শুভ্রার নাম আছে।
মাঠ থেকে শুভ্রার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে বিএলআরআই এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একে অপরকে দুষছে। অধিদপ্তর দাবি করছে, জাতটির উদ্ভাবনই ত্রুটিপূর্ণ। আর বিএলআরআই বলছে, অধিদপ্তর একে ঠিকমতো খামারিদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। তাদের কাছ থেকে নিয়ে ঘরে ফেলে রেখেছে।
বিএলআরআইয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুভ্রা সাদা জাতের ডিমপাড়া মুরগি। বিএলআরআইয়ে ‘লেয়ার স্ট্রেইন-১’ নামে পরিচিত। এ জাত উদ্ভাবনে সময় লেগেছে ১১ বছর। জাতটি তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, দেশি আবহাওয়ায় টেকসই ও রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো। মাঠপর্যায়ে শুরুতেই শুভ্রা সুনাম অর্জন করেছিল। শুভ্রার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে সোনালি রঙের ডিমপাড়া মুরগি ‘স্বর্ণা’ উদ্ভাবন করে রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
শুভ্রার জাত সম্প্রসারণ করার দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের। তারা বলছে, মাঠপর্যায়ে খামারিরা শুভ্রার বাচ্চা নিতে উৎসাহ দেখাননি। উদ্ভাবন ত্রুটির কারণে শুভ্রার যে পরিমাণ ডিম দেওয়ার কথা ছিল তা দিতে পারেনি। লাভজনক না হওয়ায় জাত সম্প্রসারণে চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দুটিও শুভ্রার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তাই শুভ্রার জাত সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি।
বিএলআরআই জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কারিগরি সহায়তায় জাপানি পিউর লাইন থেকে বাছাই ও ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে ২০১১ সালে শুভ্রা নামে বাণিজ্যিক লেয়ার বা ডিমপাড়া মুরগির জাত উদ্ভাবন করে। ওই বছরই শুভ্রাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে উৎপাদনের জন্য অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই তা এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘সাফল্যের ৮ বছর-২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে শুভ্রা স্থান পেয়েছে বিপুলভাবে। অধিদপ্তর ও বিএলআরআইও শুভ্রাকে অর্জন হিসেবেই দেখিয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনায়।
২০১৪ সালে বিএলআরআইয়ের নিউজ লেটারে (ভলিউম ৬ ইস্যু) উল্লেখ করা হয়, শুভ্রা বছরে ২৮০ থেকে ২৯৫টি ডিম দেয়। শুভ্রার বাচ্চা সহজলভ্য করার জন্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং বেসরকারি ফিনিক্স পোলট্রি ও ইকো পোলট্রির কাছে শুভ্রার প্যারেন্ট স্টক হস্তান্তর করে।
বিএলআরআইয়ের অভিযোগ, এই প্যারেন্ট স্টকের যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং তা সম্প্রসারণের দায়িত্ব ছিল অধিদপ্তর এবং ফিনিক্স ও ইকো পোলট্রির। এরা কেউ সে দায়িত্ব পালন করেনি।
কিন্তু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ড. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, শুভ্রার যে পরিমাণে ডিম দেওয়ার কথা ছিল, তা দেয়নি। বাচ্চাও কম হয়। মাঠপর্যায়ে খামারিদের শুভ্রার কিছু বাচ্চা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কৃষকেরা এটা নিতে উৎসাহী হননি। তাই মাঠপর্যায়ে শুভ্রা এখন আর দৃশ্যমান নয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রাজধানীর মিরপুরে কেন্দ্রীয় মুরগির খামারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক হারাধন চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সরকারি খামারে শুভ্রার কোনো জাত নেই। এটি ছিল ওয়ান টাইম ইয়ুজের (ব্যবহারের) মতো।’ তবে তিনি এও বলেন, চাহিদা নেই, তাই বিএলআরআই শুভ্রার পরিবর্তে উন্নতমানের স্বর্ণা জাত উদ্ভাবন করেছে।
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স হ্যাচারির ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলামও দাবি করলেন, শুভ্রাকে খামারিরা পছন্দ করেননি। ডিম দেয় কম, খায় বেশি। উৎপাদন খরচে পোষায় না। তিনি বলেন, ‘আমার খামারে বছরখানেকের বেশি সময় ধরে শুভ্রার বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ আছে। ব্যবসা করার জন্য বসেছি, রেগুলার লোকসান দিতে তো পারি না।’ তিনি বলেন, ‘অধিদপ্তরের সঙ্গে শুভ্রাকে নিয়ে পাঁচ বছরের সমঝোতা সই ছিল, দুই-তিন বছর চেষ্টাও করছিলাম। দুর্ভাগ্য দেশের।’
তবে বরিশালের বাবুগঞ্জের খামারি খলিলুর রহমান শিকদার টেলিফোনে প্রথম আলোকে বললেন, ‘শুভ্রা লাভজনক ছিল। কিন্তু এখন আমার কাছে শুভ্রা নেই। অধিদপ্তর বাচ্চা দিলে আবার শুভ্রা হবে।’ শুভ্রা পালনকারী বরিশাল বিভাগের একমাত্র এই খামারি জানান, শুভ্রার এক দিনের বাচ্চা এনে বড় করার পর ১৮ সপ্তাহে ডিম দেওয়া শুরু করে। ১০২ সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম দেয়। শুভ্রার ডিমের স্বাদও ভালো। ডিম বিক্রির পরে শুভ্রা মুরগি মাংস হিসেবে বিক্রি করা যায়।
শুভ্রা ও স্বর্ণার প্রধান উদ্ভাবক ছিলেন বিএলআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং সাবেক মহাপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, শুভ্রার উদ্ভাবনে কোনো ত্রুটি ছিল না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অবকাঠামোগত ত্রুটি এবং জনবলের সক্ষমতা নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, তা সবার জানা।
বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক নাথু রাম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্যারেন্ট লাইন হস্তান্তর করার পর অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল। অথচ শুভ্রাকে সম্প্রসারণে এ প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দুটোর নিজস্ব বিভিন্ন সমস্যার কারণে তারা শুভ্রা সম্প্রসারণে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি।
নাথু রাম সরকারের মতে, নতুন উদ্ভাবিত স্বর্ণা মুরগির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এক দিন বয়সেই মুরগির লিঙ্গ চিহ্নিত করা যায়, আর তা পালকের রং দেখেই। এই সুবিধাটি শুভ্রার বেলায় পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া শুভ্রার আর কোনো ত্রুটি ছিল না। আর যদি উদ্ভাবনগত কোনো ত্রুটি থেকেই থাকে অধিদপ্তর তো তা নিয়ে কথা বলতে পরত বিএলআরআইয়ের সঙ্গে।
তবে নাথু রাম সরকার জানান, এখনো আশা আছে, বিএলআরআই ১৭ বছর ধরে শুভ্রার প্যারেন্ট লাইন সংরক্ষণ করছে। সরকার চাইলে বাচ্চা উৎপাদন করে শুভ্রাকে আবার দৃশ্যমান করা সম্ভব।
হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বললেন, শুভ্রার প্রযুক্তিকে টেকসই করতে হলে আরও গবেষণা প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ে খামারিদেরও অনেক বেশি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শুভ্রাকে আবার দৃশ্যমান করার জন্য বিএলআরআইয়ের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
বিএলআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রাকিবুল হাসানসহ অন্যদের করা ‘ইফেক্টস অব স্ট্রেইনস অ্যান্ড টেম্পারেচার অন প্রোডাকশন পারফরম্যান্স, এগ কোয়ালিটিস অ্যান্ড ফিজিওলজিক্যাল রেসপন্স অব লেইং হেনস’ শীর্ষক গবেষণায় দেশি জাত শুভ্রা ও স্বর্ণার সঙ্গে অন্যান্য বাণিজ্যিক মুরগির তুলনায় দেখা গেছে, শুভ্রা ও স্বর্ণার ডিমের আকার বড় হওয়ায় প্রতি ডিম ৫০ পয়সা বেশি দামে বিক্রি করে খামারিরা বেশি লাভবান হন। তাপমাত্রা বাড়লে অন্যান্য বাণিজ্যিক মুরগির উৎপাদন ৫ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু শুভ্রা, স্বর্ণার কমে ৩ শতাংশ।
গবেষণা প্রবন্ধটি গত জানুয়ারি মাসে এশিয়ান জার্নাল অব অ্যানিমেল অ্যান্ড ভেটেরিনারি অ্যাডভান্সেস নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
মো. রাকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শুভ্রার জাত সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে বিদেশ থেকে এক দিন বয়সী বাচ্চা কেনা বাবদ খরচ কমে যেত।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র দাস টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শুভ্রাকে সফল উদ্ভাবন হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার ফলে এর গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। শুভ্রার পেছনে অর্থ, শ্রম ও মেধা খরচ হয়েছে। এখন বাস্তবতা হলো, শুভ্রা কোথাও নেই। শুভ্রার হদিস নেই—এই দায় কেউ এড়াতে পারে না।