প্রথমে বলা হয়েছিল একসঙ্গে বেশি যাত্রী পরিবহনের জন্য কেনা হবে জোড়া লাগানো (আর্টিকুলেটেড) বাস। এরপর সিদ্ধান্ত হয় বৈদ্যুতিক বাস কেনার। এতে সময় বেশি লাগতে পারে, এই চিন্তায় সেখান থেকে সরে এসে ডিজেলচালিত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস কেনার পরিকল্পনা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ডিজেলচালিত এসি বাসের সঙ্গে কিছু বিদ্যুৎ–চালিত বাসও কেনা হবে।
এসব বাস চলবে গাজীপুর থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মিত বাসের বিশেষ লেনে (বিআরটি—বাস র্যাপিড ট্রানজিট)। তবে সাড়ে ২০ কিলোমিটার এই বিআরটি লেনের নির্মাণ এবং এর বাস কেনার সিদ্ধান্ত নিতেই পার হয়ে গেছে এক যুগ। তিনবার প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা হয়েছে। চতুর্থবার সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কেনার প্রক্রিয়া এখন শুরু করলেও বাস পেতে এক থেকে দেড় বছর লেগে যেতে পারে। এরপর বাস পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে কোম্পানি। সব মিলিয়ে বিআরটি লেন দিয়ে বাস চালু করতে কমবেশি দুই বছর লাগতে পারে।
সাড়ে ২০ কিলোমিটার এই বিআরটি লেনের নির্মাণ এবং এর বাস কেনার সিদ্ধান্ত নিতেই পার হয়ে গেছে এক যুগ। তিনবার প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা হয়েছে। চতুর্থবার সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অথচ বিআরটি লেনের জন্য বাস কেনা, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালের ১ জুলাই শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। এর নাম ‘ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি’। শুরুতে শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও কোম্পানি সচিব দিয়ে এটি চলেছে। কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী বেড়ে এখন দুই ডজন। তবে বাস কেনা-পরিচালনার বিষয়টি কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে।
জানা গেছে, এ দফায় ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় বাড়ছে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাবটি এখন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে।
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কপথে বাসের বিশেষ লেন বা বিআরটি করতে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১২ সালে। এটি শেষ করার কথা ছিল ২০১৬ সালে। তবে মাঠপর্যায়ে কাজই শুরু হয় ২০১৭ সালে। নির্মাণকাজে ধীরগতি ও একাধিক দুর্ঘটনার কারণে বারবার কাজ পিছিয়েছে।
গাজীপুর শহরের মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা মো. হামিদুল ইসলাম (৪৫) চাকরি করেন রাজধানীর বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ৮ জুলাই তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাজীপুর থেকে রাজধানীর উত্তরা পর্যন্ত সড়কে দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। মনে করেছিলাম বিআরটি প্রকল্প চালু হলে স্বস্তি ফিরে আসবে।’ এখন প্রকল্পের কারণেই যানজটে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। কবির হোসেন নামের অপর যাত্রী যোগ করেন, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী-আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কে যানজটে আটকা পড়ে নাজেহাল হননি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরুতে বলা হয়েছিল জোড়া লাগানো বাস কিনতে ৫০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে। পরে বৈদ্যুতিক বাস কেনার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। ২০২২ সালের জুলাইয়ে ১৩০টি বৈদ্যুতিক বাস কেনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। এরই মধ্যে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ১৩৭টি ডিজেলচালিত এসি বাস কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এসব বাস কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এ খাতে ২০৫ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। তবে সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দরপত্র বাতিল করে দেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরপর দ্বিতীয় দফার দরপত্রের মূল্যায়ন শেষ হওয়ার আগেই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
বিআরটি হচ্ছে গণপরিবহনের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা। ব্যয় কম হওয়ায় এটি মেট্রোরেলের চেয়েও বেশি উপযোগী। কিন্তু যাদের বিআরটি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা অবকাঠামো নির্মাণে বেশি আগ্রহী ছিল। এ জন্য ব্যয় বাড়িয়ে, জটিল করে বিআরটির চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। এটি একটি করিডর উন্নয়ন হয়েছে।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক
৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর ডিজেলচালিত এসি বাসের সঙ্গে বিদ্যুৎ–চালিত বাস কেনার প্রস্তাব তৈরি করা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে, ১৩৭টি ডিজেলচালিত এসি ও ৫০টি বিদ্যুৎ–চালিত বাস কেনা হবে। এসব বাসের সঙ্গে থাকবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম বা আইটিএস। এর মাধ্যমে বাসের ভেতর স্বয়ংক্রিয় ভাড়া পরিশোধ ব্যবস্থা, এক বাসের সঙ্গে অন্য বাসের ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। এ ছাড়া থাকবে বাসের অবস্থান শনাক্ত করার ‘রিয়েল টাইম’ ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ–চালিত বাসের জন্য চার্জিং স্টেশনও বসানো হবে। সব মিলিয়ে এ খাতে ব্যয় দাঁড়াবে ৫৫০ কোটি টাকার বেশি। ফাইবার অপটিক লাইন বসানোর জন্যও ব্যয় যুক্ত হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডলার ও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণেও ব্যয় বাড়ছে। এ ছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় কিছু স্থাপনা ও যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো কিনতে হবে। পরামর্শক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদও ব্যয় বাড়ছে। সূত্রমতে, বাস চালিয়ে যদি কাঙ্ক্ষিত আয় না হয়, তা মেটাতেও বরাদ্দ ধরা হয়েছে। একে বলা হচ্ছে ‘ভায়াবিলিটি গ্যাপ’। এ জন্য প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া বাস পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বেশ কিছু গাড়ি কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু দামি জিপও রয়েছে। যদিও এসব গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী শেখ মঈনউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যয় আরও বেশি প্রস্তাব করা হয়েছিল। তিনি বৈঠক করে ৫০০ কোটি টাকার বেশি কমিয়েছেন। এর মধ্যে গাড়ি কেনার ব্যয় কমানো হয়েছে। এ ছাড়া কোম্পানির জন্য জমি কেনা ও অফিস ভবন নির্মাণও বাদ দিয়েছেন।
৮ জুলাই সরেজমিন দেখা যায়, একটি স্টেশনের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। অনেক জায়গায় পদচারী–সেতুর কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। কোনো কোনো স্টেশনে এস্কেলেটর ও লিফট লাগানো হয়নি। সড়কের মাঝখানে বিআরটির জন্য নির্ধারিত লেন আলাদা করার জন্য কিছু জায়গায় লোহার রেলিং লাগানো হয়েছে। তবে অনেক জায়গাতেই তা নেই।
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিশেষ বাসের লেন প্রকল্পটির নাম বিআরটি-৩। এটি রাজধানীর মহাখালী পর্যন্ত সম্প্রসারণের কথা ছিল। এরপর মহাখালী থেকে যাওয়ার কথা ছিল কেরানীগঞ্জে। তবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয় বিআরটি-৩ নির্মাণকাজের বাজে অভিজ্ঞতা।
বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত সরকারের চারটি সংস্থা। নির্মাণকাজে যুক্ত সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, সেতু বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। আর বাস পরিচালনার জন্য করা হয়েছে ঢাকা র্যাপিড বাস কোম্পানি। এর বাইরে একাধিক সমন্বয়ক ও তদারকি কমিটি রয়েছে।
প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি নামের একটি সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার।
বাস পরিচালনাসংক্রান্ত প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, এই পথে ব্যস্ত সময়ে (পিক আওয়ার) সর্বনিম্ন ৩০ সেকেন্ড পরপর বাস চলবে। স্বাভাবিক সময়ে চলবে সর্বোচ্চ তিন মিনিটের ব্যবধানে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যাতায়াতে সময় লাগবে ৩৫-৪০ মিনিট। স্টেশনের সংখ্যা ২৫।
অনেক আশায় ছিলাম, এই প্রকল্প চালু হলে আমাদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের লাঘব হবে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। আমরা দ্রুত এর সমাধান চাই।গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা একটি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন
তবে ৮ জুলাই সরেজমিন দেখা যায়, একটি স্টেশনের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। অনেক জায়গায় পদচারী–সেতুর কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। কোনো কোনো স্টেশনে এস্কেলেটর ও লিফট লাগানো হয়নি। সড়কের মাঝখানে বিআরটির জন্য নির্ধারিত লেন আলাদা করার জন্য কিছু জায়গায় লোহার রেলিং লাগানো হয়েছে। তবে অনেক জায়গাতেই তা নেই। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ময়মনসিংহ থেকে ঢাকামুখী একটি উড়ালসড়কের কাজও বাকি রয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, অনেক দিন ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় মালামাল চুরি হয়ে যাচ্ছে।
গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা একটি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আশায় ছিলাম, এই প্রকল্প চালু হলে আমাদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের লাঘব হবে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। আমরা দ্রুত এর সমাধান চাই।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটি ব্যবস্থা দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ভারতে বেশ জনপ্রিয়। ব্যস্ত সড়কের মাঝখানে বেড়া দিয়ে কম খরচে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়। তবে ঢাকা বিআরটি প্রকল্পে নানা কিছু যুক্ত করে এর ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সমতলের সঙ্গে উড়ালপথ যুক্ত করে প্রকল্পটি জটিল করে ফেলা হয়েছে। এতে নতুন করে বিনিয়োগে কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটি হচ্ছে গণপরিবহনের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা। ব্যয় কম হওয়ায় এটি মেট্রোরেলের চেয়েও বেশি উপযোগী। কিন্তু যাদের বিআরটি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা অবকাঠামো নির্মাণে বেশি আগ্রহী ছিল। এ জন্য ব্যয় বাড়িয়ে, জটিল করে বিআরটির চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। এটি একটি করিডর উন্নয়ন হয়েছে।
এই পরিবহনবিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিআরটি লেনের পাশ দিয়ে বিদ্যমান বাসও চলবে। উড়ালপথে বাসে উঠতে এস্কেলেটর, পদচারী–সেতু ব্যবহার করতে হবে। এ পথের দুই পাশে অনেক পোশাক কারখানা আছে। শ্রমিকেরা সড়ক পারাপার হন। তাঁদের জন্যও সমস্যা হবে। অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, এমন একটা চরিত্র বদলে ফেলা প্রকল্পে নতুন করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গভীর বিশ্লেষণ করা দরকার।