
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মানিকগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার পালাকার ও বয়াতি আবুল সরকারকে বিনা শর্তে মুক্তির দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। একই সঙ্গে তাঁর ভক্ত ও সমর্থকদের ওপর হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছে তারা।
মানিকগঞ্জে আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার ও তাঁর অনুসারীদের ওপর হামলার পর সারা দেশে ক্ষোভ–বিক্ষোভের মধ্যে আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ দাবিগুলো জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
বাউল আবুল সরকারের ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর ব্যাখ্যায় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, শত শত বছর ধরে গ্রামবাংলায় প্রচলিত কবিগান ও পালাগানের যে ঐতিহ্য, তারই এক ধারা হলো বিচারগান। এই ধারার গানে দুজন স্বভাবকবি বা শিল্পী দুটি পক্ষে ভাগ হয়ে যুক্তিতর্ক হাজির করেন। কথা ও গান দুই উপায়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে তর্কে হারানোর চেষ্টা করে। সেদিন জীব ও পরম—এই দুই পক্ষে লড়াই করছিলেন আবুল সরকার, প্রতিপক্ষের নামও ছিল আবুল সরকার (যিনি ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন)। আলোচ্য আবুল সরকার মহারাজ ছিলেন জীবের পক্ষে, পরমকে ছদ্ম আক্রমণই ছিল তাঁর লড়াইয়ের লক্ষ্য। সেদিন দুই কবির দার্শনিক বাহাস চলে চার ঘণ্টা ধরে। সেই চার ঘণ্টা থেকে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও কেটে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে কটূক্তি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। পরে মামলা করা হয়েছে, দ্রুত গ্রেপ্তার করাও হয়েছে।
মানিকগঞ্জের ঘিওরের এক ইমামের করা ধর্ম অবমাননার মামলায় আবুল সরকারকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এরপর গত রোববার তাঁর অনুসারীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সময় ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম–ওলামা ও তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে একদল ব্যক্তি তাঁদের ওপর হামলা চালান।
বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে চারটি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো আবুল সরকারকে বিনা শর্তে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া; যে সূত্র থেকে ভিডিও ভাইরাল করা হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা; আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে হওয়া সমাবেশে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে কট্টরবাদী ও দঙ্গলবাজদের অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক আবদার রক্ষা করার চর্চা বাদ দিয়ে সব নাগরিকের জন্য সমান আচরণ করা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার আমলের শেষের দিকে টাঙ্গাইলের বাউল রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে একই ছকে একাধিক মামলা করা হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয়। বাউল–ফকিরদের ওপর কট্টরবাদীদের এ রকম বিদ্বেষ ও হামলা নতুন নয়। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সময়ে অতি ডানপন্থীদের আস্ফালন যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারের দিক থেকে আশকারাও তারা পেয়েছে। আগে বাউলের মুক্তির দাবিতে সমাবেশ করলে সেখানে অন্তত হামলা হতো না। এবারে হলো।
সরকারের প্রশ্রয়ের কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, ৫ আগস্টের পরে শত শত মাজার ভাঙা হয়েছে, গানের আসর পণ্ড করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বহু ম্যুরাল ও ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়েছে, পথেঘাটে নারীদের অপমান–অপদস্ত করা হয়েছে, এমনকি ‘ইসলামবিরোধী’ চিহ্নিত করে কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দঙ্গলপ্রবণতা সমাজের সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে, তার কিছুটা অভ্যুত্থান–পরবর্তী অনুমিত বাস্তবতা ধরা গেলেও বেশির ভাগটাই সরকারের নীরবতা বা প্রশ্রয়ের কারণে হচ্ছে।
বাউলদের ওপর হামলার ঘটনায় দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন আনু মুহাম্মদ, গীতি আরা নাসরিন, কামরুল হাসান মামুন, ফাহমিদুল হক, আসিফ মোহাম্মদ শাহান, সামিনা লুৎফা, কাজী মারুফুল ইসলাম, কাজলী সেহরীন ইসলাম, মোশাহিদ সুলতানা, মার্জিয়া রহমান, রুশাদ ফরিদী, মাহবুবুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ।