কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে
কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস

দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা

কারিগরি শিক্ষা নিলে/বিশ্বজুড়ে কর্ম মেলে; একটাই লক্ষ্য/হতে হবে দক্ষ।

দেশের সরকারি-বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় এ রকম কিছু স্লোগান সাঁটানো আছে। স্লোগানগুলো নিঃসন্দেহে আগ্রহ–উদ্দীপক। দক্ষতা অর্জন করে দ্রুত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আশায় তরুণ-যুবকেরা কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝুঁকছেনও। সরকারি পরিসংখ্যান অন্তত তা-ই বলে। ২০০৮ সালে যেখানে কারিগরি শিক্ষার হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। সরকারের লক্ষ্য, আগামী পাঁচ বছরে এই হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করা। এ জন্য ব্যাপক কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। সবাইকে সমান সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে; তুলে দেওয়া হয়েছে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের বাধা।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানাচ্ছে, বেশ কয়েক ধরনের প্রতিষ্ঠানে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রয়েছে। যেমন প্রকৌশল কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজ ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩৬ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ৪ বছর মেয়াদি কোর্স করানো হয়। দেশে প্রকৌশল কলেজ রয়েছে ৪টি, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ৫০ ও বেসরকারি ৫৭৯টি, টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ রয়েছে ১৬৪টি। এ ছাড়া সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুরে চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্প চলমান।

স্লোগান প্রসঙ্গে আসা যাক। কারিগরি শিক্ষা নিলে সত্যিই কি বিশ্বজুড়ে কাজ মেলে? আর দক্ষতার লক্ষ্য কতটুকুই-বা অর্জিত হচ্ছে? কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় বহু তরুণের বেদনার গল্প আমাদের ঝুলিতে জমা পড়ে। তেমনই একজনের কথা বলছি। একটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা করে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর দক্ষতার কোনো মূল্যায়ন হয়নি। পেয়েছেন মজুরের কাজ। সিঙ্গাপুরের টেকনিক্যাল এডুকেশন ইনস্টিটিউটের সনদ অর্জন করতে না পারায় দুই বছর দিনমজুরি করে তিনি ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। তাঁর আক্ষেপ, দেশে চারটা বছর পড়াশোনা করেছি, এটা না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।

পাইপ ফিটিং, ইলেকট্রিক্যাল হাউসওয়্যারিং ইত্যাদি স্বল্পমেয়াদি কোর্স করে কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেন বটে, তবে সেই সংখ্যা খুবই কম। কথা হচ্ছে, আমরা ঠিক কাদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত বলব? যাঁরা ৩৬ ঘণ্টা, ২ মাস, ৩ মাস কিংবা ৬ মাসের কোর্স করে প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন করেন, তাঁদের বলতেই পারি; কিন্তু ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমাধারীরা কি কারিগর, নাকি প্রকৌশলী? আমরা কি সবাইকে ধরে নিয়েই কারিগরি শিক্ষার হার ১৮ শতাংশ বলছি? যদি তা-ই হয়, তাহলে বিষয়টা অবশ্যই গোলমেলে এবং কারিগরি শিক্ষা খাতের জন্য মোটেও শুভকর নয়।

চার বছর ধরে ডিপ্লোমা করে দেশের বাইরে গিয়ে দক্ষতা অনুযায়ী চাকরি পাওয়ার জন্য যদি আবার ডিপ্লোমা করতে হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে কর্ম মেলে কথাটার সারবস্তু কিছু থাকে না।

২০২৪ সালের এপ্রিলে কারিগরি শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে প্রকাশিত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ক্রোড়পত্র থেকে জানা যায়, আমাদের শিক্ষা, দক্ষতা, যোগ্যতা বা সক্ষমতার যে মানদণ্ড, তার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো কাঠামো নেই। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় কারিকুলামের আওতায় অর্জিত ডিগ্রি অন্য কোনো দেশে স্বীকৃতি পায় না। বৈশ্বিক মানের সঙ্গে ভারসাম্যের সীমাবদ্ধতা দূর করতে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আইএলও পরিচালিত স্কিলস-২১ প্রকল্পের কারিগরি সহযোগিতায় ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে জাতীয় কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক অনুমোদিত হয়েছে।

এখন আমাদের অপেক্ষার পালা। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে কর্ম নাই–বা মিলল, দেশজুড়ে কি মেলে? এখানে দ্বিতীয় স্লোগানটির প্রসঙ্গ এসে যায়। যাঁরা এই অঙ্গনে আসেন তাঁরা কতটুকু দক্ষ হয়ে ওঠেন আসলে? আমাদের অনেক ছাত্রকে দেখি ক্লাসের ফাঁকে নিকটবর্তী কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমেয়াদি কোর্সও করছেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ইনস্টিটিউটে ব্যবহারিক ক্লাসে ঠিক সুবিধা করা যায় না। একই অভিযোগ আমরা শিল্পকারখানার কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকেও পাই। ওখানে চাকরি পেলে আমাদের ছাত্রদের নতুন করে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হয়।

কারিগরি শিক্ষা হওয়া উচিত শতভাগ ব্যবহারিক–নির্ভর। কাগজে-কলমে হয়তো তা-ই আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই ভিন্ন বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার সদিচ্ছা আর সমন্বিত পরিকল্পনা। বৈশ্বিক উপযোগিতা মাথায় রেখে দরকার যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রণয়ন।

মাইনুল এইচ সিরাজী, শিক্ষক, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট