
দেশের সিমেন্টবাজারে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে নামী ব্র্যান্ড হিসেবে কাজ করছে ক্রাউন সিমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোল্লা মোহাম্মদ মজনু জানাচ্ছেন দেশের সিমেন্টের বাজার ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।
বাংলাদেশে সিমেন্টের বাজার কত বড়?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: বাংলাদেশের নির্মাণ খাতে সিমেন্টের বাজার বর্তমানে বেশ বড়। গত কয়েক বছরে সিমেন্টের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। যেহেতু অনেক অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, তাই সিমেন্টের চাহিদাও বেশ বেড়েছে। বছরে প্রায় ৪ কোটি টন সিমেন্ট প্রয়োজন হয় দেশের নির্মাণ খাতে, যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সমান। আমাদের দেশের বিভিন্ন সিমেন্ট উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সিমেন্ট উৎপাদনসক্ষমতা ৯ কোটি মেট্রিক টন। আমার দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার থেকে বলতে পারি, ভবিষ্যতে নির্মাণ খাতের প্রসারকে ধরে রাখতে সিমেন্টের বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে।
বাজারে ক্রাউন সিমেন্টের অবস্থান কী?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ক্রাউন সিমেন্ট দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সিমেন্ট খাতে নিজের শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছি। গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে বাজারে সুনামের ভিত্তি গড়ে তুলেছি। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ক্রাউন সিমেন্ট রপ্তানিতেও শীর্ষস্থানীয়। বিপণনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা দেশের বড় বড় বাণিজ্যিক স্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামোগত প্রকল্প ও আবাসন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছি। এর পাশাপাশি রেডি মিক্স কংক্রিট সেবার মাধ্যমে নির্মাণ খাতে আরও ভরসা জুগিয়েছি। এসব আমাদের পণ্যের বহুমুখিতা ও বাজার সম্প্রসারণের দিকনির্দেশ করে।
ক্রাউন সিমেন্টের বৈশিষ্ট্য কী?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ক্রাউন সিমেন্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর উচ্চমানের গুণগত মান, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। এর ফলে নির্মাণে দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও মজবুত শক্তি নিশ্চিত হয়। আমরা উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকি। পণ্যের স্থায়িত্ব ও মান ধরে রাখতে সর্বশেষ প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করছি। ক্রাউন সিমেন্টের কঠোর গুণগত মান নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি ব্যাচের সিমেন্টের মান পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় যে তা সব ধরনের নির্মাণকাজে যথাযথ ও নিরাপদ।
বাংলাদেশের সিমেন্টবাজারে দেশি সিমেন্টের অবস্থা কী?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: দেশীয় সিমেন্ট কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে মাথাপিছু বার্ষিক সিমেন্টের ব্যবহার মাত্র ২১০ কেজি, যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় যথেষ্ট কম। আমার ব্যক্তিগত মত, একজনের বার্ষিক সিমেন্ট ব্যবহার কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি হওয়া উচিত। দেশে জমির সংকট ও কৃষিজমিতে ভবন নির্মাণে আইনি বাধার কারণে নতুন নির্মাণে বহুতল ভবনের প্রতি নজর দিতে হবে। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্রাউন সিমেন্ট বহুতল ও আধুনিক নির্মাণের জন্য মানসম্পন্ন সিমেন্ট সরবরাহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
সিমেন্ট তৈরিতে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ভূমিকা কতটুকু?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ক্রাউন সিমেন্ট সর্বদা উদ্ভাবনী প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহী। আমরা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সিমেন্ট উৎপাদনে কাজ করছি। আধুনিক কারখানায় স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় উৎপাদন হচ্ছে। গুণগত মান বজায় রাখতে ও উৎপাদনদক্ষতা বৃদ্ধি করতে আমাদের কর্মীরা সব সময় তৎপর। পাশাপাশি আমরা গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন উপকরণ ও পদ্ধতি আবিষ্কার করছি।
কয়টা কারখানায় আপনারা সিমেন্ট উৎপাদন করেন?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ক্রাউন সিমেন্ট ২০০০ সালে একমাত্র কারখানা থেকে দৈনিক ৬০০ মেট্রিক টন সিমেন্ট উৎপাদন দিয়ে শুরু করে। ২০০২ সালে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হয় যার দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ৮০০ মেট্রিক টন। ২০০৮ সালে তৃতীয় ইউনিট চালু হয় দৈনিক ১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে। ২০১১ সালে চতুর্থ ইউনিট চালু হয় যার ক্ষমতা ছিল দৈনিক তিন হাজার মেট্রিক টন। সে বছরই ক্রাউন সিমেন্ট ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৭ সালে পঞ্চম ইউনিট চালু হয়, যার দৈনিক উৎপাদনসক্ষমতা ৫ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। ২০২৪ সালের শুরুতে মুন্সিগঞ্জে ষষ্ঠ ও সবচেয়ে বড় ইউনিট চালু হয়, যার দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা আট হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে আমাদের মোট উৎপাদনক্ষমতা দৈনিক প্রায় ২০ হাজার টনে পৌঁছেছে।
দালান নির্মাণে ভালো সিমেন্ট বেছে নিতে কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হবে?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: নগর বা গ্রামে সব জায়গায় হাসপাতাল, স্কুলসহ বিভিন্ন ধরনের দালানকোঠা ও ভবন নির্মাণে সিমেন্টের প্রয়োজন হয়। সিমেন্ট কোনো বিলাসী পণ্য নয়। ভালো সিমেন্ট নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গুণগত মান, নির্ভরযোগ্যতা আর পরিবেশগত উপযোগিতা প্রধান বিষয়। নির্মাণ প্রকল্পের ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী সিমেন্টের ধরন নির্বাচন করা উচিত। উচ্চমানের সিমেন্ট অবশ্যই শক্তি, স্থায়িত্ব ও আবহাওয়া প্রতিরোধক্ষমতায় উন্নত হতে হবে। পরিবেশবান্ধব পণ্য নির্বাচন ভবিষ্যৎ নির্মাণ খাতের জন্য অপরিহার্য।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ক্রাউন সিমেন্ট ভবিষ্যতে আধুনিক প্রযুক্তি আরও বাড়িয়ে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি ও নতুন বাজার সম্প্রসারণের ওপর জোর দিচ্ছে। গুণগত মান উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও রপ্তানি সম্প্রসারণ আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় ক্রাউন সিমেন্টকে শীর্ষে রাখতে অবিরত কাজ করে যাচ্ছি।
রপ্তানির ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: সিমেন্টশিল্পে উচ্চ অগ্রিম কর রয়েছে। এ কারণে দেশের স্থানীয় সিমেন্ট উৎপাদক হিসেবে আমাদের ওপর আর্থিক চাপ রয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের শুল্ক ও কর একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। শুল্ক সমন্বয় করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
নির্মাণক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে কী কাজ করছেন?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: আমাদের দেশের শ্রমিকেরা কোনো কাঠামোবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ পান না। নির্মাণকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ক্রাউন সিমেন্ট নিয়মিত নিরাপত্তা কর্মশালা আয়োজন করে থাকে এবং বিনা মূল্যে নিরাপত্তা সরঞ্জাম বিতরণ করে। দুর্ঘটনায় পতিত নির্মাণকর্মীদের জন্য এককালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কেউ আহত হলে বা মারা গেলে আমরা তাঁর পরিবারকে সাহায্য করছি করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির অংশ হিসেবে। এর পাশাপাশি আমাদের ব্যবসায়িক সহযোগী ও প্রকৌশলী এবং তাঁদের পরিবারের জন্য বছরজুড়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য হেলথ ইনস্যুরেন্স বেনিফিট ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছি। শুধু মজবুত নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করাই নয়, নির্মাণক্ষেত্রে কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।