পাঠকের হাতে বই তুলে দেওয়া শখ কাজী এমদাদুল হকের। গাঁটের পয়সা দিয়ে গত পাঁচ বছরে সারা দেশের ৪৯৫টি বেসরকারি পাঠাগারে বই দিয়েছেন বলে জানালেন তিনি। কোনো কোনো পাঠাগারে ৩০ বার পর্যন্তও বই পাঠিয়েছেন। তা–ও প্রতিবার ১০০ থেকে ২০০ কপি। এভাবেই ২৫ লাখ টাকার বেশি বই কিনেছেন বিভিন্ন জেলা–উপজেলার বেসরকারি পাঠাগারে পড়তে আসা পাঠকের জন্য।
এদিকে মানুষ মন দিয়ে বই পড়ছে, এ দৃশ্য দেখতে এমদাদুল হকের ভালো লাগে। তাই বই কুরিয়ারে করে পাঠালেও মাঝেমধ্যে নিজেই চলে যান বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বেসরকারি পাঠাগারগুলোতে।
গত ২৮ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর কথা হয় কাজী এমদাদুল হকের সঙ্গে। পাঠাগারে বই বিলিয়ে বেড়ানোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারে যে বই পাঠায় সেসবের মান দেখলে খুব কষ্ট হয়। এত খারাপ বই কেনা হয়! মানুষকে তাঁর মনের খোরাক দিতে হয়। না হলে পাঠক তৈরি হয় না। তাঁর হাতে ভালো বই তুলে দিতে আমার ভালো লাগে।’
কাজী এমদাদুল হকের বাবা কাজী আবদুল গনি ১৯৮০ সালে মৃত্যুর আগে ছেলেকে বলেছিলেন, নিজে ভোগের চেষ্টা কম করে, অর্থ না জমিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়াতে। বাবার সেই উপদেশ তিনি মনে রেখেছেন।
ভালো বই বলতে ঠিক কী বোঝেন, জানতে চাইলে এমদাদুল হক বলেন, ‘পাঠাগারগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা নিয়ে বই কিনি। অর্থাৎ সেখানকার পাঠক কোন ধরনের বই পড়তে চান, সেই চাহিদা অনুযায়ী বই কেনা হয়। আর নিজের ইচ্ছায় দিতে হলে দেশের লেখকদের আলোচিত ও বিষয়ের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বই কেনা হয়।’
এমদাদুল হক আরও বলেন, ‘ভালো বইয়ের কিন্তু অভাব নেই। এক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গেলেই কত ভালো বই পাওয়া যায়!’
এমদাদুল হক জানালেন, পাঠাগারের কাছ থেকে বইয়ের তালিকায় গুরুত্ব পায় বেশি বাংলাপিডিয়া আর হুমায়ূন আহমেদের বই। তিনি নিজের ইচ্ছায় অথবা পাঠাগারগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বই কেনেন বলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো দরপত্র আহ্বান করে, নানা রকম হিসাব–নিকাশ, লাভ-লোকসান বুঝে বই কিনতে হয় না তাঁকে।
তবে নিজের সম্পদ খুব সামান্য। সারা দেশে বই বিলিয়ে বেড়ানো মানুষটি বললেন, মানুষের সদিচ্ছার একটা শক্তি আছে। ঠিকই হয়ে যায় কোনো না কোনোভাবে।
এমদাদুল হক বই কেনেন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু অর্থ ও নিজের পেনশনের টাকা থেকে। তাঁর কাছ থেকে বই পাওয়াটা পাঠাগারগুলোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে বিভিন্ন পাঠাগারের কয়েকজন পরিচালক ও গ্রন্থাগারিক বললেন, সরকারের চেয়ে বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায় তাঁর কাছ থেকে।
‘কাজী এমদাদ কত বই দিয়েছেন হিসাব নাই। পাঠাগার শুরুর সময় নিজ উদ্যোগে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। এরপর গত তিন বছরে ৩০ বারের বেশি বই পাঠিয়েছেন। প্রতিবার দুই শ থেকে আড়াই শ বই দেন।রোবায়েত হোসেন, ত্রিশালের রানীগঞ্জ পাঠাগারের উদ্যোক্তা
‘সরকারি প্রতিষ্ঠান এতখানি করতে পারে না, এমদাদ ভাই একাই যা করেন’
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে অবস্থিত উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সাইফী আনোয়ারুল আজিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমদাদ ভাই অন্তত ৮০০ বই দিয়েছেন আমাদের। কুরিয়ার খরচটা পর্যন্ত নিজে দেন। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান এতখানি করতে পারে না, এমদাদ ভাই একাই যা করেন সারা দেশের পাঠাগারগুলোর জন্য।’
একই রকমের মন্তব্য পাওয়া গেল মৌলভীবাজারের চুনগর পাঠাগার আর ঝালকাঠি সদরের নারায়ণ মিস্ত্রি পাঠাগারের কাছ থেকেও।
নারায়ণচন্দ্র হালদার জানালেন, ঝালকাঠিতে তাঁর পাঠাগারে অন্তত আটবার বই পাঠিয়েছেন কাজী এমদাদুল হক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দেখে বই দিতে নিজেই যোগাযোগ করেছেন তিনি (এমদাদুল)। এরপর ঝালকাঠিতে এসেছেন এ পাঠাগারে বেড়াতে।
শুধু বই নয়, কেউ অর্থসহায়তা চাইলে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করেও টাকা ধার দেওয়ার অভ্যাস আছে এমদাদুল হকের। তবে প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও কম নেই জীবনে। মিথ্যে বলে টাকা চাওয়ার সময় অবশ্য বুঝতে পারেন, এ টাকা আর কখনো ফেরত পাবেন না তিনি। বিষয়টা তিনি অন্য রকম করে ভাবেন। বললেন, ‘মানুষ যখন মিথ্যা বলে, সেই মিথ্যা তাঁকে সাজাতে হয়। মানুষটা নিজে সেটা জানে। আরেকজনের কাছে ধার নিতে যাওয়া মানেই কিছু না কিছু কষ্ট আছে। সাহায্য করা মানে সেই কষ্টটার মূল্য দেওয়া।’
কাজী এমদাদুল হকের বাবা কাজী আবদুল গনি ১৯৮০ সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে ছেলেকে বলেছিলেন, নিজে ভোগের চেষ্টা কম করে, অর্থ না জমিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়াতে। বাবার সেই উপদেশ তিনি মনে রেখেছেন এখনো।
এমদাদুল হক সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন ২০১৫ সালে। ১৯৭৪ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পড়া হয়নি। সেই আক্ষেপ তাঁর আছে। প্রথম আলোকে বললেন, ‘১৯৭৪ সালে মুহসীন হলে সেভেন মার্ডারের ঘটনা ঘটে। সূর্য সেন হলের সাত ছাত্রকে মুহসীন হলে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে মারা হয়েছিল। আমার বাবা এত ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি আর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যেতে দিতে চাননি।’
এমদাদুল হক পরে ডিগ্রি পাস করেন শরীয়তপুর থেকে। এরপর কর্মজীবনে প্রবেশ। সবশেষ শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা কার্যালয়ের একজন কর্মী ছিলেন। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরে। স্ত্রী হাসিনা মমতাজ ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর পরিবার। ছেলে কাজী আবদুল্লাহ আল হাসান শিক্ষার্থী। মেয়ে মেহজাবিন আফরোজ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
এমদাদুল হক বলেন, পরিবারের সদস্যরা কখনো তাঁর কাজে বাধা দেননি। উল্টো সমর্থন দিয়েছেন। বয়স ও দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় নিজে যে খুব বেশি বই পড়েন, তা নয়। তবে বই কিনে মানুষকে দেওয়া তাঁর নেশা।
এমদাদুল হকের এ আগ্রহ কতখানি, তা টের পাওয়া গেল ময়মনসিংহের ত্রিশালের একটি বেসরকারি পাঠাগার থেকে। সেখানকার রানীগঞ্জ পাঠাগারের উদ্যোক্তাদের একজন রোবায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজী এমদাদ কত বই দিয়েছেন হিসাব নাই। পাঠাগার শুরুর সময় নিজ উদ্যোগে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। এরপর গত তিন বছরে ৩০ বারের বেশি বই পাঠিয়েছেন। প্রতিবার ২০০ থেকে ২৫০টি করে বই দেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী এমদাদুল হক বললেন, রানীগঞ্জ পাঠাগারের জন্য তাঁর একটু বেশি পক্ষপাত আছে সত্যি। কেননা, তাঁর জন্ম ও বাবার চাকরি সূত্রে জীবনের ২২ বছর কেটেছে ময়মনসিংহে।
মঠবাড়ি ইউনিয়নের এ পাঠাগারে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ জন পাঠক আসেন। যাঁদের হাতে উঠে আসে রাজধানী থেকে একক উদ্যোগে পাঠানো একজন এমদাদুলের দেওয়া শত শত বই। এভাবে দেশের প্রায় ৫০০ পাঠাগারে পৌঁছে গেছে এ মানুষটির কিনে দেওয়া হাজার হাজার বই।