
অনেক প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ একটি পরিবর্তিত পরিবেশে অবস্থান করছি উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, এই পরিবর্তন স্থায়ী করতে হলে গুমের বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানের হোটেল আমারিতে ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ: গুম মোকাবিলায় বিচার বিভাগের ভূমিকা’ শীর্ষক এক কর্মশালার উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের উদ্যোগে ঢাকার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সহযোগিতায় কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়।
গুম হত্যার চেয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধ উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, গুম প্রতিরোধে শুধু আইনগত সংস্কার নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও প্রয়োজন।
গুমের বিচার বাস্তবায়নে বিচারকদের সাহসী ও ন্যায্য ভূমিকা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও দৃঢ় অবস্থানই এক দিন বাংলাদেশ থেকে গুমের সংস্কৃতি নির্মূল করবে।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, গুম প্রতিরোধে বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও মানবাধিকার কাঠামোর মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগ ও তদন্ত সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি গুমের বিচার নিশ্চিতের মূল চাবিকাঠি।
গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, গুম-সংক্রান্ত মামলাগুলোর কার্যকর তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি। তিনি জানান, কমিশন ইতিমধ্যে বিদ্যমান আইনি কাঠামো পর্যালোচনা করছে। গুম–সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, সাক্ষী সুরক্ষা ও ভুক্তভোগী পরিবারের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের প্রস্তাব প্রস্তুত করছে।
কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব লিয়াকত আলী মোল্লা এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান।
কর্মশালাটি পরিচালনা করেন গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস। দেশের বিভিন্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে কর্মরত বিচারকসহ প্রায় ৯০ প্রশিক্ষণার্থী এতে অংশগ্রহণ করেন। ওয়ার্কিং সেশন পরিচালনা করেন কমিশনের সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন। এই পর্বে গুম-সংক্রান্ত মামলায় প্রমাণ সংগ্রহ, সাক্ষ্য গ্রহণ, মানবাধিকার মানদণ্ডের প্রয়োগ ও বিচারপ্রক্রিয়ার জবাবদিহি নিশ্চিতের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
আলোচনায় গুম প্রতিরোধে একটি স্থায়ী গুম প্রতিরোধ কমিশন গঠন, গুম প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন, বিচার বিভাগের আওতায় স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা, গুম–সংক্রান্ত মামলার জটিলতা নিরসনে মনিটরিং সেল গঠন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বিচারকদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ আয়োজনের সুপারিশ উঠে আসে। আলোচনায় ভুক্তভোগীদের মানসিক ও আইনি সহযোগিতা নিশ্চিত করা, আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা, সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা এবং অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) সহজ করার বিষয়গুলো উঠে আসে।
কর্মশালা থেকে গুমের চিহ্নিত মামলাগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিষ্পন্ন করা, বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে ভুক্তভোগীদের সহজে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা, ম্যাজিস্ট্রেটদের মিথ্যা মামলা নিরসন–সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রদানের সুপারিশ করা হয়। আলোচনায় বিচার বিভাগ ও কমিশনের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের কাঠামো উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও উঠে আসে।