
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ সাল সবচেয়ে ঝঞ্ঝাপূর্ণ বছরগুলোর একটি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বাঁকবদলের মাস ছিল পঁচাত্তরের নভেম্বর। এই অস্থির সময়, বিশেষ করে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, অন্য কোনো সময় নিয়ে তত হয়নি। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিপরীতে ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান। এ সময়ের নানা স্মৃতি, দলিল ও মতামত নিয়ে থাকছে প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজন।
শেখ আবদুল আজিজ স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের যোগাযোগ, কৃষি, তথ্য এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় বসেন। ২৩ আগস্ট আরও অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন শেখ আবদুল আজিজ। ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার সময় জাতীয় চার নেতাসহ আরও অনেকে একই সঙ্গে ছিলেন। সেই রাতের সাক্ষী শেখ আবদুল আজিজ। আজ প্রকাশিত হলো তাঁর সেই সময়ের স্মৃতিচারণামূলক লেখা।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামন, এই লেখক শেখ আবদুল আজিজ ও আবদুস সামাদ আজাদ—এই ৬ জনকে ১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট একসঙ্গে গ্রেপ্তার করে আমাদের পল্টনে কন্ট্রোল রুমে একটি ভাঙা বাড়িতে নেওয়া হয়। আমরা বসা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ আহমদকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জনৈক কর্নেল ফারুককে অনুরোধ করেছিলেন।
কর্নেল ফারুক উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনাদের সবার ট্রায়াল এখানে হবে।’ আমাদের উদ্দেশ করে বলা হয়েছিল, ‘ইউ উইল হ্যাভ টু জাস্টিফাই ইয়োর করাপশন।’ এ কথা শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, এটা কোর্ট নয়, আদালত নয়, কীভাবে এখানে বিচার হবে? এই পরিস্থিতিতে আমাদের পরস্পরের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে মেজর ডালিম এসে এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগল। কামরুজ্জামান ডালিমকে বলেছিল, ‘এ রকম তো কথা ছিল না!’ তারপর ডালিম চলে গেল। আমাদের সামনে আমাদের সহানুভূতিশীল পুলিশ কর্মচারীরা দৌড়াদৌড়ি করছিল। কিছু সময় পর তারা এসে বলল, ‘আপনারা এই গাড়ি ও মাইক্রোবাসে তাড়াতাড়ি ওঠেন; সেন্ট্রাল জেলে যেতে হবে।’ আমরা গাড়িতে উঠলাম এবং ভাবলাম, বেঁচে গেলাম। সেন্ট্রাল জেলে প্রবেশ করলাম। আমাদের নতুন জেলে থাকার জায়গা করে দেওয়া হলো।
নতুন জেলে এককালে জেল ডাইরেক্টরের অফিস ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কয়েদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জেল ডাইরেক্টরকে অপসারণ করে এখানে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার পর রাজবন্দীদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। নিয়তির পরিহাস, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ অনেক আওয়ামী লীগ কর্মীর এই নতুন জেলে বন্দী অবস্থায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এই জেলে একদিকে তিনটি রুম–সমন্বিত ১টি ইমারত আছে। এর সম্মুখের দিকে কয়েকটি সেল ও তৎসংলগ্ন ফাঁসির মঞ্চ আছে।
সবচেয়ে ছোট এক নম্বর রুমে আমি, নজরুল ইসলাম সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, কোরবান আলী, আনোয়ার জং, আবদুল কুদ্দুস মাখন, চুয়াডাঙ্গার ডাক্তার আছাবুল হক জোয়ার্দার প্রমুখ (সবাই আওয়ামী লীগ দলীয়) ছিলাম। দুই নম্বর রুম আমাদের রুমটির দ্বিগুণ ছিল। সেখানে এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব সাবেক সিএসপি, সচিব আসাদুজ্জামান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ডাক্তার হায়দারসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছিলেন। তিন নম্বর রুমটি ছিল একটি বড় হলরুম। এই রুমে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদ, সংসদ সদস্য নারায়ণগঞ্জের জোহাসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছিলেন। আমরা যারা সাবেক মন্ত্রী ছিলাম, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম শ্রেণির সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের তৃতীয় শ্রেণির বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এই জেলে আমাদের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য মানবেন্দ্রনাথ লারমাও বন্দী ছিলেন।
আমাদের রাজবন্দীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা জেলখানায় একটি ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেছিলাম। এই ম্যানেজিং কমিটি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাপনা ছাড়াও নিয়মিত বিভিন্ন রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনা করত। আমরা যখন বন্দী ছিলাম, তখন গোপালগঞ্জের আমিনুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জেলার ছিলেন। তিনি আমাদের জানাতেন, মাঝেমধ্যে রাত দুইটার পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্রধারী মিলিটারি কর্মকর্তারা জেলখানায় প্রবেশ করে আমাদের অবস্থান দেখে যেত। আমরা এসব কথা শুনে ধারণা করতাম, আমাদের বোধ হয় ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হবে। এ সত্ত্বেও জেলারের কথায় আমাদের মনে অশনিসংকেত পেলাম।
অতঃপর রাজবন্দীদের জেলখানার ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদক আবদুস সামাদ আজাদকে বাইরে আন্তর্জাতিক রেডক্রসে সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয় এই মর্মে যে জেলখানায় অস্ত্রধারী সামরিক কর্মকর্তারা নিশীথ রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের অবস্থান দেখে যায়। আবদুস সামাদ আমাদের বলতেন, তিনি আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতিকে এ সম্বন্ধে জানিয়ে দিয়েছেন। অথচ পরে আমরা জানতে পারি যে আবদুস সামাদ আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে এসব ঘটনা জানায়নি। উল্লেখ্য, এই আবদুস সামাদ আজাদ রাজনৈতিক জীবনে দোতরফা মনগড়া কথা বলায় অভ্যস্ত ছিলেন।
জেলখানা থেকে বাইরে অবৈধভাবে চিঠি পাঠানো খুব দুষ্কর ছিল। আমাদের চিঠিপত্র পাঠানোর একটি চ্যানেল ছিল। সেই চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা চিঠি পাঠাতে গেলে ভুল–বোঝাবুঝি হওয়ার সম্ভাবনায় আমরা চুপ থাকলাম। এরপরও জেলার আমিনুল ইসলাম আমাদের বলতেন, প্রায়ই সেনানিবাস থেকে আর্মি অফিসাররা অস্ত্র নিয়ে জেলখানায় প্রবেশ করে। জেল কোডে অস্ত্র নিয়ে অন্য কোনো বাহিনীর জেলখানায় প্রবেশ করা নিষেধ। জেল কর্তৃপক্ষের নিষেধ অমান্য করে আর্মির কর্মকর্তারা অস্ত্র নিয়ে নিয়মিত জেলে প্রবেশ করে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর অনুমান রাত ২টার সময় জেলখানায় অ্যালার্ম বা পাগলা ঘণ্টা বাজতে থাকে। আমি এক নম্বর রুমর দরজার পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম। মাথার পাশে কথা শুনে আমি ঘুম থেকে জাগলাম। জেগে দেখি, তাজউদ্দীন ও কোরবান আলী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। জেল সুবেদার আমাকে বললেন, ‘আপনারা সবাই তিন নম্বর রুমে যান।’ এরপর নজরুল ইসলাম আমাকে বললেন, ‘আপনারা সবাই যান। আমি ও তাজউদ্দীন পরে আসছি।’ এ বলে তাঁরা বাথরুমে চলে গেলেন। তাঁদের কাছে জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কিছু চিঠিপত্র ছিল। তাঁরা চিঠিগুলো ছিঁড়তে গিয়েছিলেন। আমি সবার আগে তিন নম্বর রুমর গেটে যাই। তখন সুবেদার গেট খুলছেন মাত্র। ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেব গেটে দাঁড়ানো অবস্থায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে? তখন তাঁর হাতে তসবিহ ছিল।
আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী কারণে পাগলা ঘণ্টা বাজে? তিনি কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। আমি ভাবলাম, হয়তো কোনো আসামি পালিয়ে গেছে, তার জন্য পাগলা ঘণ্টা দিচ্ছে। তাজউদ্দীন বললেন, ‘আসামির সংখ্যা গোনার সময় ধরা পড়বে। এখন কেন পাগলা ঘণ্টা বাজবে?’ ইতিমধ্যে জেল সুবেদার আবদুল ওয়াহেদ সিকদার আমাদের রুমর সামনে এলেন। জেলের ভেতরের চাবি জেল সুবেদারের কাছে থাকে। জেল সুবেদার আমাদের রুমর দরজার তালা খুলতে লাগলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দরজা খোলেন কেন?’ তিনি আমাদের আস্তে আস্তে জানান, জেলখানায় মিলিটারি এসেছে।
আমি এ কথা শুনে ঘুমন্ত নজরুল ইসলাম সাহেবকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললাম, মিলিটারি এসেছে। এ কথা শুনে তিনি তাঁর সিটে চলে গেলেন। আমি হলের ভেতরে প্রবেশ করলাম ও হলসংলগ্ন পেছনের বারান্দায় গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম। আমার সঙ্গে আবদুল কুদ্দুস মাখন, আনোয়ার জং প্রমুখ হলের ভেতরে থাকল। তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম যখন তিন নম্বর রুমর দিকে আসছিলেন, তখন জেলার আমিনুল ইসলাম চিৎকার করে বললেন নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনকে এক নম্বর রুমে ঢুকতে। আমার ধারণা হয়েছিল যে তিন নম্বর রুমটি খুব বড় হল। এখানে আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীকে সমবেত করে মিলিটারি গুলি করে মারবে।
ইতিমধ্যে আবার এক নম্বর রুমে নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন সাহেবকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা শুনে চিন্তিত হলাম। কারণ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন সাহেব এক নম্বর রুম থেকে বের হয়ে তিন নম্বর রুমের দিকে আসছিলেন। কী কারণে তাঁদের আবার এক নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ হলো, তা শুনে চিন্তিত হলাম।
আরও চিন্তিত হলাম, জেলার যে ভাষায় নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনকে নাম ধরে এক নম্বর রুমে ঢোকাতে বলেছিলেন, তা–ও ছিল অস্বাভাবিক ব্যবহার। এ ঘটনার পর আমি এক নম্বর রুমের দিকে গুলির আওয়াজ শুনলাম। আমাদের হল থেকে আবদুল কুদ্দুস মাখন বলল, এটা গুলির আওয়াজ নয়; বোমার শব্দ। সে আরও বলল, মিলিটারিরা যাওয়ার সময় বোমা মেরে চলে গেছে। এর আধা ঘণ্টা পরে রাতের বাঙালি জেল গার্ড আমাদের জানিয়ে গেল, মিলিটারিরা তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান—এই চারজনকে এক নম্বর রুমে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে।
আরও চিন্তিত হলাম, জেলার যে ভাষায় নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনকে নাম ধরে এক নম্বর রুমে ঢোকাতে বলেছিলেন, তা–ও ছিল অস্বাভাবিক ব্যবহার। এ ঘটনার পর আমি এক নম্বর রুমের দিকে গুলির আওয়াজ শুনলাম।
এ খবর শোনার পর আমরা ফজরের নামাজ পড়লাম। আমি মোনাজাতের মাধ্যমে শহীদদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করলাম; সঙ্গে আমরা যেন জেলখানায় জীবিত থাকতে পারি, এ জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। দুপুর বারোটার সময় মরদেহের গন্ধ ছুটল। আমরা মরদেহের গন্ধ পেলাম। তখন আমরা আমাদের রুম খুলে দেওয়ার জন্য চিৎকার করতে লাগলাম। বেলা প্রায় দুইটার দিকে এক নম্বর রুমে মরদেহের মুখ দেখতে পারলাম। এক নম্বর রুমে গিয়ে দেখি, অসংখ্যক গুলিতে দেয়ালগুলো ছিদ্র হয়ে গেছে।
বেলা প্রায় দুইটার সময় খুলনার ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম জেলখানা থেকে কামারুজ্জামানের মরদেহ রাজশাহীতে নিয়ে গেল। অপর তিনটি মরদেহ জেলখানায় থাকল। আমরা জেল কর্মকর্তাদের কাছে মরদেহগুলো গোসল করানোর দাবি করায় তারা মরদেহ গোসল করিয়ে এক নম্বর রুমে রাখল। ইতিমধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক সামরিক অফিসার জেলখানায় প্রবেশ করলেন। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি তাঁকে বলি, এভাবে মরদেহ ফেলে রাখা উচিত নয়। তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা কী করবেন? আপনারা এর প্রতিশোধ নেবেন, সে সুযোগ আপনারা কখনো পাবেন না।’ কর্মকর্তাটি আরও বললেন, কুমিল্লা ও যশোর থেকে আর্মি মার্চ করে ডেমরা পর্যন্ত ইতিমধ্যে চলে এসেছে। তার বলার বিষয় ছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের ক্যু সম্বন্ধে।
২ নভেম্বর শেষ রাতে ঢাকার আকাশে অসংখ্য জেট প্লেন মহড়া দিচ্ছিল। জেলখানা থেকে আমরা এর কারণ বুঝতে পারলাম না। পরে জানতে পেরেছিলাম যে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হয়ে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে প্রবেশ করে জেলে আটক আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা সামরিক ক্যু বা অভ্যুত্থান করে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন। জেনারেল ওসমানী খন্দকার মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন।
ওসমানী সাহেবের হস্তক্ষেপে খন্দকার মোশতাক স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। খন্দকার মোশতাক বুঝতে পারলেন যে তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তবে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকেও ক্ষমতায় বসতে দেবেন না। এ উদ্দেশ্যে খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সামরিক কর্মকর্তারা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে ঢাকার ডিআইজি প্রিজন আপত্তি করেন। তখন খুনিদের পরামর্শমতো খন্দকার মোশতাক ডিআইজি প্রিজনকে তাঁদের জেলে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে নির্দেশ দেন। ডিআইজি প্রিজন এই অবৈধ কাজে খুনিদের বাধা দিলে তারা ডিআইজি প্রিজনকে প্রহার করে।
ইতিমধ্যে রাত প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে অনুমান রাত তিন অথবা সাড়ে তিনটার সময় সামরিক কর্মীরা জেলে বন্দীদের মধ্যে চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নতুন জেলের এক নম্বর রুমে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। গুলির পরও তাজউদ্দীন সাহেব জীবিত ছিলেন। গুলির বেদনা সহ্য করতে না পেরে তিনি কাতরাচ্ছিলেন। এ সময় একজন জেল প্রহরী এ খবর শুনে জেল গেটে গিয়ে ঘাতকদের এ খবর জানায়। ঘাতকেরা খবর পেয়ে আবার এক নম্বর রুমে ফিরে আসে এবং তাজউদ্দীন সাহেবকে হত্যা করে চলে যায়। ঘাতকদের দ্বিতীয়বার এক নম্বর রুমর ফিরে আসার শব্দ আমি পাশের রুম থেকে শুনতে পাই।
হত্যার পর মোশতাক আহমদ হেলিকপ্টারযোগে হত্যাকারীদের ব্যাংককে পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনায় জেনারেল ওসমানীর ভূমিকা স্বচ্ছ ছিল না। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একদল সামরিক কর্মকর্তা মোশতাককে বন্দী করতে চেয়েছিলেন। ওসমানী সাহেব আপসের অছিলায় খুনি মোশতাককে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। ওসমানী মোশতাককে গ্রেপ্তার করতে খালেদ মোশাররফকে অনুমতি দেননি। বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপস করে মোশতাককে রক্ষা করলেন। জেনারেল ওসমানীকে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা সম্মান করত, কারণ, জেনারেল ওসমানী বেঙ্গল রেজিমেন্টের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সুযোগের অপব্যবহার করে তিনি খুনি মোশতাককে বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ তিন দিন স্থায়ী ছিল। অভ্যুত্থানের সময় জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
জেলে তিন নেতার জানাজায় পল্টনে হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়েছিল। এরপরও খালেদ মোশাররফ জেলহত্যার নেতা তথা মুক্তিযুদ্ধের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হাইকোর্টসন্নিহিত হক-সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করতে দেননি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অভ্যুত্থানের পর সেনানায়কের ব্যাচ পরিধান করানো হয়েছিল, এ ছবি আমি জেলখানা থেকে পত্রিকায় দেখেছিলাম। তিন দিনের অভ্যুত্থানের পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, তার সহকর্মী সামরিক অফিসার কর্মকর্তাসহ অনেকে পাল্টা অভ্যুত্থানে নিহত হয়।
উল্লেখ্য, এই পাল্টা বিদ্রোহ সংগঠিত করে সংগঠনের নায়ক জাসদ সমর্থক কর্নেল তাহের ও জাসদ পার্টি। কর্নেল তাহের ও জাসদ ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করে প্রত্যেক সৈনিকের মন কলুষিত করে এই মর্মে যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ভারতের সাহায্যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নজরবন্দী রাখা হয়। যে কারণেই হোক, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করে সাধারণ সামরিক জওয়ানদের ভেতর জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এসব কারণে তড়িৎগতিতে কর্নেল তাহের ও জাসদের মিথ্যা প্রচার সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের ভেতর কাজ করেছিল। ফলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পতন ঘটে।
সূত্র: রাজনীতির সেকাল ও একাল: শেখ আবদুল আজিজ।