
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে গোয়েন্দারা আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকার কোটা সংস্কারের পক্ষে থাকলেও শিক্ষার্থীদের তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। অপর দিকে ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করাও ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তাই এসব ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগকে ভুলগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আজ সোমবার রাজধানীতে বেসরকারি সংগঠন গৌরব ’৭১ আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় এ কথাগুলো উঠে আসে। আওয়ামী লীগের নেতা, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘সন্ত্রাস, নাশকতা ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে এই মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল। সেই তথ্য বের করতে গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াত ছাত্রদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল।
মাহবুব উল আলম হানিফ দাবি করেন, গণমাধ্যমে এসেছে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে এক পুলিশ সদস্য। পত্রপত্রিকায় এসেছে, ওই পুলিশ সদস্য ইসলামী ছাত্রশিবির করতেন। এই ঘটনাও চক্রান্তের অংশ কি না, তা তদন্ত করা দরকার। এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের যেখানে যা প্রয়োজন, তা করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সানজিদা খানম আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যাঁর যাঁর জায়গা থেকে প্রতিহত করা হলে এই ঘটনা ঘটত না। আমাদের ব্যর্থতার ফসল এই আন্দোলন। কোটা নিয়ে ছাত্রদের আবেগ ও সরকারের উদ্যোগ একই ছিল। কিন্তু সেটা আমরা কেন মানুষকে বোঝাতে পারলাম না? সেই মাশুল দিতে হলো।’ তিনি শিক্ষার্থীদের আর ঢাল না হওয়ার আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে সাফল্য আসে না। তিনি বলেন, এখন আত্মসমালোচনার দরকার আছে। সংকট উপলব্ধি না করলে, সংকটের কাছে পৌঁছাতে না পারলে সংকট যাবে না।
ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করার অপচেষ্টা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সংসদ সদস্য ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, একটি পক্ষ কীভাবে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠল, সে খবর রাখার দরকার ছিল। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো বেশি করে প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের আত্মসমালোচনা করে ভুল সংশোধন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। তিনি বলেন, ‘কোটার বিরুদ্ধে গোটা দেশ ছিল, এটা মানতে হবে। কিন্তু গোড়াতেই কেন সমস্যার সমাধান করা হলো না? আন্দোলনে অন্য পক্ষ ঢুকে পড়েছে বলে তথ্য ছিল। তাহলে কেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে দুটি বিদেশি দূতাবাসে বসে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এসব বিষয়ে তথ্য জানাতে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল।’
শ্যামল দত্ত আরও বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগকে ভুলগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, এই সংকট আবারও আসতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিকশিত প্রজন্ম তৈরিতে ব্যর্থতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়ানো হয় না শিক্ষার্থীদের। প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগরিত করতে ব্যর্থতার ঘটনা ঘটেছে। এখন শুধু অর্থনৈতিক বিকাশ নয়, সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে পরাজিত করতে হবে।
এত হতাহতের পেছনে ছাত্রশিবির দায়ী উল্লেখ করে সাবেক ছাত্রনেতা সালাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, তারা ছাত্রদের ব্যবহার করেছে। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার। কিন্তু গণমাধ্যমে অন্যান্য নিহত ব্যক্তিদের খবর আবেগ দিয়ে প্রকাশ করলেও নিহত ছাত্রলীগ নেতা–কর্মী ও পুলিশের খবর সেভাবে প্রকাশ হয়নি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি ঝুনা চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রহিমা মুক্তা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহীনুর রহমান, সাবেক ছাত্রনেতা শেখ মেহেদী হাসান, ছাত্রলীগের স্কুলছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রাজীব আহমেদ, সাংবাদিক মানিক লাল ঘোষ প্রমুখ।
আলোচনা অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন গৌরব ’৭১–এর সভাপতি এস এম মনিরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন।