ময়মনসিংহ নগরের শশীলজে গ্রিক দেবী ভেনাসের ভাস্কর্য গত বছরের ৫ আগস্ট ভেঙে ফেলা হয়
ময়মনসিংহ নগরের শশীলজে গ্রিক দেবী ভেনাসের ভাস্কর্য গত বছরের ৫ আগস্ট ভেঙে ফেলা হয়

এক বছর ধরে ভাঙা পড়ে আছে ভাস্কর্যগুলো

রাজধানীর শিশু একাডেমির সামনে শিশুর ভাস্কর্য ‘দুরন্ত’র স্থানে এখন একটি ব্যানার রাখা আছে। সেখানে ‘দুরন্ত’ নেই।

দিনাজপুরের তেভাগা চত্বরে তির-ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারক সিধু-কানুর ভাঙা ভাস্কর্য থানা-পুলিশের হেফাজতে আছে।

এমন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ২০টি ভাঙা-ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য-ম্যুরালের কোনোটির সংস্কার হয়নি গত এক বছরে। ভাস্কর্যশিল্পীরা বলছেন, এই ভাস্কর্যগুলো দেশের ঐতিহাসিক ও নান্দনিক ঐতিহ্য। তাই এগুলোর সংস্কার জরুরি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, রিলিফ ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-ক্ষতিগ্রস্ত-গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য, জাতীয় চার নেতাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাস্কর্য-ম্যুরাল আছে। আছে মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও প্রসঙ্গের প্রতীকের ভাস্কর্য-ম্যুরাল।

ঢাকার যত ভাস্কর্য

রাজধানীর শিশু একাডেমির সামনের এখানে ছিল শিশুর ভাস্কর্য ‘দুরন্ত’। এখন সেখানে একটি ব্যানার রয়েছে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা

গতিশীল ঢাকার প্রতীক শিশু একাডেমির ‘দুরন্ত’ ভাস্কর্য। গত বছর ৫ আগস্ট বিকেলে হামলা চালিয়ে ভেঙে ফেলা হয় চাকা নিয়ে দৌড়াতে থাকা শিশুর ভাস্কর্যটি। চলতি বছরের ১১ আগস্ট সরেজমিনে দেখা যায়, ভাস্কর্যটি কোথাও নেই। সেখানে ‘বি দ্য লাইট’ লেখা একটি ব্যানার রাখা আছে।

শিশু একাডেমির মহাপরিচালক দিলারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, একাডেমির জায়গা নিয়ে মামলা আছে। এ বছর দুবার আদালত থেকে এই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে আপাতত দুরন্ত পুনর্নির্মাণ বা স্থাপনের কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

রাজধানীর শিশু একাডেমির সামনে ছিল এই ‘দুরন্ত’ ভাস্কর্য
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, রিলিফ ভাস্কর্য, ম্যুরাল, স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-ক্ষতিগ্রস্ত-গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

ভাস্কর শামীম সিকদারের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যের অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের শেষ প্রান্তে। এখানকার ত্রিভুজ আকৃতির সড়কদ্বীপে ছোট-বড় শতাধিক ভাস্কর্য ছিল। এর মধ্যে অক্ষত আছে মাত্র পাঁচটি। বাকিগুলো ভেঙে ফেলা হয়। এগুলোর মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ইয়াসির আরাফাত, জগদীশচন্দ্র বসু, লালনসহ দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, বিপ্লবী, রাজনীতিক, বিজ্ঞানীদের আবক্ষ ভাস্কর্য আছে। চলতি বছরের ১৩ আগস্ট সরেজমিনে দেখা যায়, ভাস্কর্যগুলো যেভাবে ভেঙে ফেলে রাখা হয়েছিল, এখনো সেভাবেই আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের শেষ প্রান্তে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্য ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি ফেলে দেওয়া হয় গত বছরের ৭ আগস্ট। ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা ভাস্কর্যটির হাতে ছিল ন্যায়দণ্ডের প্রতীক। একদল লোক রশি দিয়ে বেঁধে টেনে ভাস্কর্যটি ফেলে দেয়। এখন জায়গাটি ফাঁকা রয়েছে।

জেলার চিত্র

ময়মনসিংহের শশীলজে থাকা ভেনাসের ভাস্কর্যটির প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য অপরিসীম বলে মনে করেন ভাস্কর্যশিল্পীরা। গত বছরের ৫ আগস্ট শশীলজের ফোয়ারার মাঝখানে থাকা গ্রিক দেবী ভেনাসের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়। ভাঙা ভাস্কর্যটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। ভাস্কর্যের জায়গাটি রয়েছে খালি। প্রথম আলোর ময়মনসিংহের নিজস্ব প্রতিবেদক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ভাস্কর্যটি সংস্কারের কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ২০টি ভাঙা-ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য-ম্যুরালের কোনোটির সংস্কার হয়নি গত এক বছরে। ভাস্কর্যশিল্পীরা বলছেন, এই ভাস্কর্যগুলো দেশের ঐতিহাসিক ও নান্দনিক ঐতিহ্য। তাই এগুলোর সংস্কার জরুরি।

ময়মনসিংহ শহরে জয়নুল সংগ্রহশালার সামনে থাকা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্যটি গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ভাঙচুর করা হয়। পরে অবশ্য স্থানীয় চারুশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে ভাস্কর্যটি মেরামত করা হয়।

মেহেরপুরের ‘মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স’কে একক ভাস্কর্য হিসেবে ধরা হয়। সেখানে পাঁচ শতাধিক পৃথক ভাস্কর্য ছিল। কমপ্লেক্সের অন্তত ৩০৩টি ছোট-বড় ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয় গত বছরের ৫ আগস্ট বিকেলে। প্রথম আলোর মেহেরপুর প্রতিনিধি আবু সাইদ গত ৯ আগস্ট ঘটনাস্থলে যান। তিনি জানান, গত বছর ভেঙে দেওয়া ছোট আকারের ভাস্কর্যগুলো মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের হেফাজতে আছে। ভাস্কর্য সংস্কারের কোনো উদ্যোগের তথ্য নেই বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ঐতিহাসিক মূল্যে দিনাজপুরের তেভাগা চত্বর, নান্দনিক ও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক মূল্যে শিশু একাডেমির দুরন্ত আর প্রত্নমূল্যের দিক থেকে ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাসের ভাস্কর্যের গুরুত্ব অপরিমেয়। জনমত তৈরি হলেও এগুলো সংস্কারের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু এই ভাস্কর্যগুলোর সংস্কার হওয়া জরুরি।
—নাসিমুল খবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান
স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারক সিধু-কানু ভাস্কর্যের ভাঙা অংশবিশেষ। ছবিটি দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মোড় এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা

মাদারীপুর জেলা শহরের নির্মাণাধীন ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ স্মৃতিকেন্দ্রে গত বছরের ৭ আগস্ট হামলা হয়। সেখানকার ছোট-বড় ভাস্কর্য ও টেরাকোটা ভেঙে ফেলা হয়। এগুলো এখনো একইভাবে পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন প্রথম আলোর মাদারীপুর প্রতিনিধি অজয় কুন্ডু।

সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারক সিঁধু-কানু ভাস্কর্য। গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দিনাজপুরের তেভাগা চত্বরের সিধু-কানু ভাস্কর্য ভাঙা হয়। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিধু-কানুর ভাস্কর্য আবার স্থাপনের জন্য এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমি আমার অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ভাবা হচ্ছে এটা নিয়ে।’

টাঙ্গাইল শহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার ম্যুরাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় গত বছরের ডিসেম্বরে।

চলতি বছরও ভাঙচুর

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের ‘কৃষাণ চত্বর’ ভাস্কর্যটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভাঙা হয়

চলতি বছরও দেশের বিভিন্ন স্থানে ম্যুরাল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে তিন রাস্তার মোড়ের ‘কৃষাণ চত্বর’ ভাস্কর্যটি পরিচিত গ্রামবাংলার কৃষি ও কৃষকের ঐতিহ্য হিসেবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাস্কর্যটি ভাঙা হয়। সুনামগঞ্জের প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক খলিল রহমান জানান, ভাস্কর্যটি সংস্কারের বিষয়ে কোনো উদ্যোগের তথ্য পাওয়া যায়নি।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে চার রাষ্ট্রপতির ম্যুরাল ভাঙা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। এগুলো আর সংস্কার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রথম আলোর কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি তাফসিলুল আজিজ।

বরগুনার নৌকা জাদুঘরে স্থান পেয়েছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিলুপ্ত ও প্রচলিত ১০০ ধরনের নৌকার প্রতিকৃতি। এই জাদুঘরে ভাঙচুর চালানো হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। প্রতিকৃতিগুলোর কিছুই আর এখন অবশিষ্ট নেই বলে জানিয়েছেন প্রথম আলোর বরগুনা প্রতিনিধি মোহাম্মদ রফিক।

বিজয় সরণিতে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণে থাকা ম্যুরালসংবলিত সাতটি দেয়াল ভাঙা হয় চলতি বছরের জুনে। এসব দেয়ালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের দিন পর্যন্ত বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চিত্রিত করা হয়েছিল। এখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জুলাই শহীদদের স্মরণে ভাস্কর্য ও উন্মুক্ত স্থান তৈরি করবে বলে জানা যায়।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের গুরুত্বপূর্ণ ২০টি ভাঙা-ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য-ম্যুরাল সংস্কারের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান নাসিমুল খবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহাসিক মূল্যে দিনাজপুরের তেভাগা চত্বর, নান্দনিক ও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক মূল্যে শিশু একাডেমির দুরন্ত আর প্রত্মমূল্যের দিক থেকে ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাসের ভাস্কর্যের গুরুত্ব অপরিমেয়। জনমত তৈরি হলেও এগুলো সংস্কারের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু এই ভাস্কর্যগুলোর সংস্কার হওয়া জরুরি। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগ কারিগরি সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে।’