
শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদির খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে আজ রোববার বেলা দুইটা থেকে সারা দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সর্বাত্মক অবরোধ পালনের ঘোষণা দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।
গতকাল শনিবার রাত পৌনে একটার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক ফেসবুক পোস্টে এ কথা জানানো হয়। এর আগে রাত সাড়ে ১১টার দিকে শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচি থেকে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের বেলা ১১টায় কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে আজ ডিএমপির সংবাদ সম্মেলন থাকায় সেটি পর্যালোচনার পর বেলা দুইটা থেকে পরিবর্তিত কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘আট বিভাগে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করছি। শহীদ ওসমান হাদির রক্তের সঙ্গে কোনো আপস চলবে না। হাদির খুনের সঙ্গে কারা কারা জড়িত, তাদেরকে জনসমক্ষে প্রকাশ না করা পর্যন্ত অবরোধ চলছে, চলবে। সকলকে এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। হাদি হত্যার বিচারের প্রশ্নে কারও সঙ্গে আপস করব না।’
ঘোষণার আগে রাত ১১টার দিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী শাহবাগে আসেন। সেখানে আন্দোলনরত জনতার উদ্দেশে হাদি হত্যাকাণ্ডের অগ্রগতি তুলে ধরেন। ৭ জানুয়ারির মধ্যে হাদি হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করার কথাও অঙ্গীকার করেন তাঁরা। তবে এই প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে ইনকিলাব মঞ্চ।
বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তিনি হাদির একজন গুণগ্রাহী। তিনি হাদিকে নিজের ভাই মনে করেন। দেশের জন্য তাঁকে আরও বেশি দিন প্রয়োজন ছিল। যেই মানুষের মৃত্যুতে ১২ থেকে ১৫ লাখ মানুষ জানাজা পড়ে, সেই মানুষের মৃত্যুর বিচার আসলে একটি জাতীয় কর্তব্য।
৭ জানুয়ারির মধ্যে চার্জশিট দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, শহীদ হাদিকে যারা খুন করেছে, এর পেছনে যারা কাজ করেছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, একটা শত্রুপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাজটা করতে হচ্ছে। যে তথ্যটা বলা হবে, সেটি যেন শত্রুকে কোনোভাবে সাহায্য না করে। এই হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্টভাবে চার্জশিট ৭ জানুয়ারির মধ্যে দেওয়া হবে। চার্জশিট দেওয়ার পরে অন্তর্বর্তী সরকার থাকাকালীন দ্রুত বিচার করা হবে। সেই নিশ্চয়তা দেন তিনি।
আছিয়া হত্যাকাণ্ডের (মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলা) প্রসঙ্গ টেনে উপদেষ্টা বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে ছয় কার্যদিবসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা গিয়েছিল। অতএব চার্জশিটটা যেন নির্ভুলভাবে দেওয়া যায়, কোথাও কোনো ফাঁকফোকর না থাকে। সেটি সম্পন্ন হওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই করতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অনেক সময় অপরাধী যদি পালিয়েও থাকে, তারপরও কিন্তু বিচার করা যায়। শেখ হাসিনার বিচার হয়েছে। তারপরও আমাদের সর্বান্তঃকরণ চেষ্টা আছে হাদিকে যারা শহীদ করেছে, তারা যদি বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়ে থাকে, তাদেরকে আমরা অবশ্যই দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি। এই বার্তা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভারত সরকারকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে অপরাধীকে যদি ভারতে খুঁজে পাওয়া যায়, তারা অবশ্যই বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।’
উপদেষ্টার বক্তব্যের আগে ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার তদন্তের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, এই ঘটনার পেছনে কারা আছে, তা উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য সব গোয়েন্দা বাহিনীকে নিয়োগ করেছে সরকার। ইতিমধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি পিস্তল, মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। ২১৮ কোটি টাকার সই করা চেক উদ্ধার করা হয়েছে। যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। আাগামী ১০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ৭ জানুয়ারির মধ্যে এই মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
ডিএমপি কমিশনার ও উপদেষ্টার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘বলা হয়েছে, তদন্তের ৯০ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। তাহলে বাকি ১০ শতাংশ কাজ করতে ৭ তারিখ পর্যন্ত লাগবে কেন? আগামী তিন দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিল করতে হবে। দ্রুততম সময় বলতে কিছু বুঝি না।’
ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আরও বলেন, ‘তারা বলেছে প্রয়োজনে খুনিকে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে বিচার করা হবে। এই খুনের সবচেয়ে ছোট ঘুঁটি হচ্ছে যে এই গুলিটা করেছে। এর পেছনে রাঘববোয়াল কারা আছে, জানাতে হবে। ওসমান হাদিকে শুধু এই শুটার নিজ উদ্যোগে খুন করে নাই। খুনিকে শুধু নিয়ে আসলেই হবে না।’
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদির খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে গত শুক্রবার দুপুর থেকে শাহবাগে টানা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা–কর্মীরা। এতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষও যোগ দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে নারী ও শিশুরাও রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শীত উপেক্ষা করে শাহবাগ মোড়ের মাঝখানে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন নেতা–কর্মীরা। একটু পরপর স্লোগান দিচ্ছেন। চলছে কবিতা আবৃত্তি, কেউ আবার হাদিকে নিয়ে বানানো গানও গাইছেন। কেউ আবার একটু হেঁটে গিয়ে দূর থেকে জিয়ারত করে আসছেন হাদির কবর! একটু পরপর হাদি হত্যার বিচার চেয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। সকালের দিকে মানুষের সংখ্যা কম থাকলেও দুপুরের পর তা বাড়তে থাকে। অবস্থান চলাকালে শাহবাগেই তাঁরা জোহর, আসর ও মাগরিবের নামাজ পড়েন।
এ সময় মঞ্চের নেতা–কর্মীরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘গোলামি না আজাদি, আজাদি আজাদি’, ‘যেই হাদি জনতার সেই হাদি মরে না’, ‘ফাদার অব টেররিস্ট, মোদি মোদি’, ‘হাদি না মোদি, হাদি হাদি’, ‘হাদি ভাই মরল কেন, ইন্টেরিম জবাব দে’, ‘হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।
গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা থাকায় ইনকিলাব মঞ্চের স্বেচ্ছাসেবকেরা ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পৌঁছাতে সহায়তা করেন। পরীক্ষা শেষে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অনেকে এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
অবস্থান চলাকালে গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ-সংলগ্ন এলাকায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করতে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় অবস্থান সরিয়ে আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে চলে যান ইনকিলাব মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। কবর জিয়ারত শেষে তারেক রহমান ফিরে গেলে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা আবার শাহবাগে অবস্থান নেন। তার পর থেকে তাঁরা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে হাদি হত্যার খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানান। এর ফলে শুক্রবার দুপুর থেকে শাহবাগ মোড় দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ যায়।
শহীদ ওসমান হাদি গত বছরের আগস্টে ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সরব হয়ে সারা দেশে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থী হতে প্রচারও চালাচ্ছিলেন তিনি। ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য ওসমান হাদিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। হাদি হত্যা মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল করিম নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তাঁকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।