ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এসএমএ রাশীদুল হাসান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগীরা তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর শিক্ষক কবি ও সাহিত্যিক আনোয়ার পাশার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ২২ দিন পর অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহের সঙ্গে তাঁর মরদেহ ঢাকার মিরপুরে বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের কন্যা রোকাইয়া হাসিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সময় আমরা প্রতি রাতে আনোয়ার পাশা চাচার বাসায় গিয়ে থাকতাম। সকাল নয়টার দিকে ছয়–সাতজন লোক আসেন। তাঁরা আনোয়ার চাচাকে ডেকে নিয়ে যান। এ সময় তাঁরা আমার বাবার নাম জানতে চান। নাম শুনেই তাঁরা বললেন, আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। সেই বাবার সঙ্গে আমাদের শেষ স্মৃতি।’
মৃত্যুর আগপর্যন্ত রাশীদুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর ঘটনা নিয়ে রোজনামচা লিখেছেন। এই রোজনামচার ১১ পৃষ্ঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদস্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। এতে তিনি মুক্তির জন্য প্রতীক্ষার মূহূর্তকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। সেই প্রতীক্ষার প্রহরে তাঁর কাছে বাংলাদেশ যেন হয়ে ওঠে ‘একটি মানুষ, একটি কণ্ঠ’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদস্মৃতি সংগ্রহশালায় দুটি ডিসপ্লে বোর্ডে তাঁর রোজনামচার ১১টি পাতা প্রদর্শন করা আছে। একটিতে পাঁচটি, অপরটিতে ছয়টি পাতা রয়েছে। কোনো কোনো পাতায় তারিখ-বার–সময় উল্লেখ করেছেন। কোনোটি আবার অন্য পাতার অংশ। সেটি এখন ঠিকমতো মেলানো যায় না। ১২৩ নম্বর পাতায় ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা লিখেছেন। ১৭৬ নম্বর পাতায় লিখেছেন সোয়াত জাহাজ থেকে সেনাবাহিনীর অস্ত্র খালাস করার কথা। এ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ডায়েরির ১১টি পাতা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই শিক্ষাবিদের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার বড়শিজা গ্রামে। তাঁর মায়ের নাম খাদিজা বেগম এবং বাবার নাম মৌলভি মোহাম্মদ আবু সাঈদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে তিনি নরসিংদী কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও কলকাতার কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
তাঁর রোজনামচার কয়েকটি পাতা এ রকম—বুধবার ৩ মার্চ ১৯৭১। ‘শোক দিবস’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘কথা ছিল আজ হবে জাতীয় পরিষদের শুভ উদ্বোধন। পাকিস্তানের ইতিহাসের সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হবে আজ শপথগ্রহণ। সারা দেশ ছিল উদগ্রীব, উৎকণ্ঠিত। আমাদের ইতিহাসকে গৌরব চিহ্ন ধারণ করে বাঁচবার প্রতয় ছিল এ দিনে। কিন্তু সে মহৎ প্রত্যাশা ধূলিস্যাৎ করে দিয়ে গত পয়লা মার্চ ঘোষিত হলো: না, জাতীয় পরিষদের উদ্বোধন ঘোষণা হবে না। তাই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, আজ আমাদের জাতীয় শোক দিবস—বাংলাদেশের শোক দিবস। বাঙালির শোক দিবস।’
একই পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শোক মিছিল শিরোনামে লিখেছেন, ‘সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের অবিস্মরণীয় বটতলায় আমরা মিলিত হলাম। এই প্রথম ছাত্রদের বটতলায় আমরা সম্মিলিত হলাম। ঘটনা তাৎপর্যময়। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল ছাত্রগণ, যোগ দিলেন জনতা কিশোর ও তরুণেরা। রিকশাওয়ালা ও কৃষক শ্রমিক ভাইয়েরা। শিক্ষকের ভাষণে শপথ পঠিত হলো। তাদের মাঝে ছাত্র ভাইয়েরা উদ্দীপ্ত হলো। অণুপ্রাণিত হলো। শিক্ষক ছাত্রদের ব্যবধান ঘুচে গেল। আমরা ছাত্রজনতার ব্যানারে শরিক হলাম, মিশে গেলাম। ছাত্রশিক্ষক জনতার এক নবশক্তির অভ্যূত্থান ঘটল। আমাদের প্রতিবাদ মিছিল বটতলা হয়ে “রোকাইয়া” হলের পাশ দিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, আমাদের মেয়েরা বিস্ময়ে আনন্দে তা নিরীক্ষণ করছিল—তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা আজ মিছিলের পুরোভাগে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা তাদের শিক্ষকদের এই পুরোধার ভূমিকাই তো কামনা করে।’
তারিখ না দিয়ে এই পাতার মাঝামাঝি থেকে ‘মিছিলের শুরু ও শেষে তরুণের লাশ’ শিরোনামে লিখতে শুরু করেছেন, ‘মিছিলে যোগ দিতে যাবার পথে ছাত্র জনতা হাসপাতাল থেকে পাঁচটি লাশ কাঁধে করে বয়ে আনছে দেখা গেল। তারা লাশ নিয়ে ইকবাল হলে (এখন ছাত্রদের দেওয়া নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এসে থামলেন। মর্মস্পর্শী দৃশ্য। জনতার চোখে মুখে অগ্নি শপথ। জনৈক বীর তরুণের হাতে খোলা বন্দুক, এদের সকলের হাতে যদি আগ্নেয়াস্ত্র থাকতো তাহলে বুঝি এরা যেকোনো শক্তিদুর্গ উড়িয়ে দিতে সক্ষম।’
সোমবার ৮ মার্চ ১৯৭১ ‘গভীর বেদনা যখন’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক বিবৃতির পর একদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। সারা বিশ্বে তার বাণী ছড়িয়ে পড়ল। সারা বাংলাদেশে এখন বেদনার সিন্ধু। আমার এক একটি মুহূর্ত একেকটি শতাব্দীর মত দীর্ঘ মনে হচ্ছে দেশের কী হবে? বাংলার মানুষ এবারও কি তার ন্যায্য প্রাপ্য পাবে না?’
‘কী অপরাধ তারা করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো অথচ স্বাধীন দেশের লোক হয়েও সেদিন থেকেই আমরা পরাধীন হলাম।। বাংলাদেশের মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য। জাহাজ জাহাজ সৈন্য নাকি গোপনে করাচি থেকে চট্টগ্রামের বন্দরে ভিড়ছে-কেন? আমরা ন্যায় বিচার, সুবিচার চেয়েছি- এই অপরাধে? বেদনার এই চরমকালে আমি পাক কোরআন ও মহাগ্রন্থ বাইবেলের বাণী থেকে এবং আল্লার প্রার্থনায় নিজেকে সমর্পন করে সান্তনা ও শান্তির সন্ধান করছি। আল্লাহর মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ শঁপে দিয়েই আমার শান্তি। তিনি অবশ্যই জালেমের জুলুমের যোগ্য শাস্তির বিধান করবেন। বেদনা ও বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই তিনি অসহায় বাঙালিকে যোগ্য পুরস্কার দেবেন। বাংলাদেশের এই মহান সংগ্রাম কখনো বৃথা যাবে না। আমিন!!!’ প্রতিটি লেখার শেষেই সময়সহ নিজের স্বাক্ষর করেছেন। এই লেখাটি শেষ করেছেন রাত ১১টা ২০ মিনিটে।