
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম জীবনভর সাম্য ও মানুষের জয়গান গেয়েছেন। শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর গান প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর দর্শন ও গানের মূল কথা মানুষের মুক্তি। তাঁর সৃষ্টিকর্মের চর্চা বাড়াতে হবে। সুনামগঞ্জে দুই দিনব্যাপী শাহ আবদুল করিম লোক উৎসবের উদ্বোধনী আলোচনায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেছেন।
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের ১০৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর জন্মস্থান সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের মাঠে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে এই উৎসব শুরু হয়েছে। শাহ আবদুল করিম পরিষদ আয়োজিত উৎসবে এবারও সহযোগিতায় আছে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ।
শুক্রবার বিকেলে সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, উৎসব মাঠের চারদিকে সবুজ ফসলের সমারোহ। পড়ন্ত বিকেলে মাঠজুড়ে হাজারো মানুষ। করিমের বাড়ির দক্ষিণ পাশে কালনী নদীর তীরের করচগাছের তলায় ছোট ছোট দলে জলসা বসিয়ে তাঁর গান গান গাইছেন শিল্পীরা। সেই গানের সুর ছড়িয়ে পড়ছে উজানধলের বাতাসে, কালনী নদীর জলে-ঢেউয়ে।
শুধু মাঠে নয়, উৎসব ঘিরে বাউল করিমের বাড়ি, বাড়ির পাশে কালনী নদীর তীরে করিমের ভক্ত-অনুরাগীদের মিলনমেলা বসেছে।
বাউল শাহ আবদুল করিম পরিষদের সভাপতি ও শাহ আবদুল করিমের ছেলে বাউল শাহ নূর জালালের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সমর কুমার পাল, দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সনজীব সরকার, বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম, স্থানীয় তাড়ল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলী আহমদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্কৃতিকর্মী দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, করিম যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, তেমনি মানুষও শাহ আবদুল করিমকে ভালোবাসত। সেই ভালোবাসার টানেই মানুষ এখানে ছুটে আসে। শুদ্ধ স্বরে ও কথায় তাঁর গান গাইতে হবে, এটা তিনি নিজেও চাইতেন। কিন্তু নানা মাধ্যমে এখন তাঁর গান বিকৃত সুরে প্রচার হচ্ছে, এটি দুঃখজনক।
বক্তারা আরও বলেন, শাহ আবদুল করিম এই উজানধলের বসন্ত বাতাসে, তাঁর প্রিয় নদী কালনীর জলে-ঢেউয়ে মিশে আছেন। মানুষই ছিল করিমের ধ্যানজ্ঞান। শাহ আবদুল করিম লোক উৎসব হলো সাম্য-মৈত্রীর মিলন উৎসব।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘সুনামগঞ্জ সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি জেলা। এখানে অসংখ্য বাউল, সাধক ও গুণীজন জন্মেছেন। বাউল শাহ আবদুল করিম সাধারণ কথায় অসাধারণ বিষয়কে সহজ করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম ধরে রাখতে যেকোনো উদ্যোগে প্রশাসন পাশে থাকবে।’
উদ্বোধন শেষে মঞ্চে বাউলসম্রাটের জনপ্রিয় গান গাইতে শুরু করেন তাঁর ভাবশিষ্যরা। দূরদূরান্ত থেকে আসা করিম–ভক্তরা তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন। উৎসবের উদ্বোধনী দিনে বাউল করিমের জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন বাউল রনেশ ঠাকুর, আবদুর রহমান, আবদুল তোহায়েদ, সিরাজ উদ্দিন, ইমরান শাহ, প্রাণ কৃষ্ণ, লাল শাহ, আজগর আলী, শান্তা সরকার, শারমিন প্রমুখ। এই শিল্পীরা বাউল করিমের, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে...’, ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান...’, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে...’, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে, দিওয়ানা বানাইছে...’, ‘গাড়ি চলে না চলে না রে...’, ‘তুমি আমার আমি তোমার...’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু...’, ‘তুমি বিনে আকুল পরান...’, ‘তুমি মানুষ আমি মানুষ...’–সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। শনিবার উৎসব শেষ হবে।
বাংলা লোকগানের এই বাউলসম্রাটের স্মরণে ২০০৬ সাল থেকে এ উৎসব আয়োজিত হয়ে আসছে। উৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভক্ত-সাধকদের পাশাপাশি সংগীতপ্রেমীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে উজানধল গ্রাম। এই উজানধল গ্রামেই ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।