
ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালেই বছরের বেশির ভাগ সময়ই চোখে পড়ে ধোঁয়াশায় ঢাকা এক নগরী। চোখ জ্বালা, গলা খুসখুস এবং দীর্ঘস্থায়ী কাশি যেন ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী।
বছরের পর বছর এই শহর বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, যে শহরের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ৩০০-এর কাছাকাছি বা তার ওপরে থাকে সেটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা গত ডিসেম্বরেই রেকর্ড করেছে ২৮১ একিউআই স্কোর, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘দুর্যোগপূর্ণ’ স্তর। এমন দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদ্রোগ এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করে।
ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস একাধিক, তবে উল্লেখযোগ্য এই চারটি উপাদান—
১. পুরোনো, অযোগ্য যানবাহন চলাচল
২. ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া
৩. নির্মাণকাজের ধুলাবালি
৪. খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানো।
বিশেষ করে পুরোনো ফিটনেসবিহীন বাস ও ট্রাক থেকে প্রতিনিয়ত যে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়, তা শহরের বাতাসে অতি ক্ষুদ্র কণা (পিএম ২.৫) ছড়িয়ে দেয়। এই ক্ষুদ্র কণা ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে, যেখান থেকে তা রক্তপ্রবাহে পৌঁছে যায়। যার ফলে দেখা দেয় হৃদ্রোগ, ফুসফুসে ক্যানসার, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ এবং অ্যাজমার মতো জটিল রোগ।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় জানানো হয়, শুধু ২০১৯ সালে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে ৭৮ হাজার থেকে ৮৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। একজন মানুষ দূষিত বাতাসে প্রতিদিন যা গ্রহণ করছেন, তা গড়ে প্রায় ১.৭টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণেরা এই দূষণের প্রধান ভুক্তভোগী। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি ও খিঁচুনি হয়; প্রবীণেরা হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়।
বলা হয়, ঢাকায় জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশু যেন জন্মের পর থেকেই বিষাক্ত বায়ুর মধ্যে প্রথম শ্বাস নেয়, আর তার সঙ্গে জীবনের শুরুতেই ঝুঁকিপূর্ণ এক যাত্রাও শুরু হয়ে যায়।
সম্প্রতি একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে নারীদের মধ্যে গর্ভপাতের হার বেড়েছে, পুরুষদের শুক্রাণুর মান কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ভবিষ্যতে জন্মহার ও শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। শুধু তা–ই নয়, গর্ভের শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন ও ওজনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শীতকালে বায়ুদূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই সময় বাতাস চলাচল করে কম, ফলে ধুলাবালি ও ক্ষতিকর গ্যাসগুলো বাতাসে জমে থাকে। আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকার বাতাস সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
দূষণ মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই শহর একদিন বাসযোগ্য থাকবে না। নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে এখনই প্রয়োজন সমন্বিত নীতিমালা, কঠোর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতা। তাই পুরোনো যানবাহন চলাচল বন্ধ, ইটভাটার জন্য বিকল্প প্রযুক্তির ব্যবস্থা, নির্মাণস্থলে পানি ছিটিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ, ঢাকায় অবৈধ যানবাহনের নিবন্ধন বাতিল এবং নগরবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
এই প্রতিটি পদক্ষেপ একত্রে গ্রহণ করতে পারলেই বায়ুদূষণ রোধে একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত সমাধানের পথ তৈরি করা সম্ভব। এখন সময়, কথায় নয়, কাজে দেখানোর।
একটি শহর তখনই প্রাণবন্ত থাকে, যখন তার নাগরিকেরা মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারেন। ঢাকাবাসীর সেই মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে। প্রতিটি শ্বাসেই যেন লুকিয়ে আছে অসুস্থতা, ভোগান্তি। দূষণ যে শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের জীবনব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, তা নিয়ে আর কোনো দ্বিধা নেই। সময় এখন কথার নয়, কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করার।