প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষক পদ বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয় গানে গানে। ঢাকা। ৭ নভেম্বর
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষক পদ বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয় গানে গানে। ঢাকা। ৭ নভেম্বর

মানববন্ধন

প্রাথমিকে শারীরিক ও সংগীত শিক্ষক পদ পুনর্বহালের দাবি

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষক পদ বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে গানে গানে রাজধানীর রাজপথ পরিক্রম করলেন শিক্ষার্থী-সংগীতশিল্পীসহ সংগীতানুরাগী নাগরিকেরা। তাঁরা অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে ওই শিক্ষক পদ পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন।

আজ শুক্রবার বিকেলে ধানমন্ডির আবাহনী ক্লাব মাঠের সামনে সাতমসজিদ রোডে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সংগীত ও চারুশিল্পী, যুব সংগঠনের নেতাকর্মী ও সংগীতানুরাগী সাধারণ নাগরিকেরা সমবেত হয়ে মানববন্ধন করেন। ‘প্রাথমিক শিক্ষাকে শিশুর সুকুমার বৃত্তি বিকাশের উপযোগী করে তোলো’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এই প্রতিবাদী আয়োজন করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল ‘তোমার ভয় নেই মা/ আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’, ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’—এমন গানের বাণী লেখা পোস্টার। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদী কার্যক্রম।

এই প্রতিবাদী আয়োজনের আয়োজকদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী রিমেল সরকার। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এই প্রতিবাদে তাঁদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ৪৭২ জন নাগরিক স্বাক্ষর করেছেন। এতে বলা হয়, ‘গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের চাপের মুখে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষক পদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে শিশুদের সৃজনশীলতা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা শিশুদের সৃজনশীলতা, আবেগীয় ও নান্দনিক বোধ, সামাজিক সংহতির চেতনা গঠনের জন্য অপরিহার্য। এ কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রে শিল্প-সংস্কৃতি ও সৃজনশীল শিক্ষাকে রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে এই বিষয়গুলো সংকুচিত করা শিক্ষানীতি ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।’

আয়োজকেরা কিছু সময় সাতমসজিদ সড়কে ব্যানার, পোস্টার নিয়ে মানববন্ধন করে অবস্থান করেন। এরপর শুরু হয় তাঁদের প্রতিবাদী গানের মিছিল। ঢাকা। ৭ নভেম্বর

লিখিত বক্তব্য বলা হয়, ‘আমাদের দেশের গণ-আন্দোলনে সব সময় সংগীত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গণমানুষকে আন্দোলিত করেছে, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। এখন বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে সংগীত শিক্ষা বন্ধের এই সিদ্ধান্ত শুধু শিক্ষানীতিতেই নয়, একই সঙ্গে দেশের বহুমাত্রিক সামাজিক চরিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মুক্তচিন্তার মূল্যবোধের ওপরও আঘাত হেনেছে। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের এক বিপজ্জনক পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো সব সময়ই সমাজকে একমাত্রিক করতে চায়। শিল্প-সাহিত্য, সৃজনশীলতাকে দমন করতে চায়। ভিন্নমত ও নান্দনিক চেতনার পরিবর্তে একতরফা মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে অসাম্প্রদায়িকতার সংস্কৃতি ও মানবিকতার ওপরে। সে কারণে শরীরচর্চা ও সংগীত শিক্ষাদান বন্ধের উদ্যোগ বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।’

প্রতিবাদী এই আয়োজন থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক ও সংগীত শিক্ষার জন্য শিক্ষক পদ পুনর্বহাল করা ও কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডার কারণে শিক্ষানীতির এমন পরিবর্তন বন্ধের জোর দাবি করা হয়। একই সঙ্গে শিশুদের সার্বিক বিকাশে শিল্প–সংস্কৃতি ও সৃজনশীল শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, শিক্ষানীতি নির্ধারণে কোনো গোষ্ঠীর চাপে নয়, রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ, শিক্ষাবিদ ও মননশীল সমাজের মতামতের প্রাধান্য দেওয়ার দাবি করা হয়।

লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের পর আয়োজকেরা কিছু সময় সাতমসজিদ সড়কে ব্যানার, পোস্টার নিয়ে মানববন্ধন করে অবস্থান করেন। এরপর শুরু হয় তাঁদের প্রতিবাদী গানের মিছিল। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’, ‘পথে এবার নামো সাথি’, ‘জাত গেল জাত গেল বলে’, ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’,‘সংকোচের বিহ্বলতা’, ‘গ্রামের নওজোয়ান’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’—এমন দেশাত্মবোধ ও প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত গানের পর গান গেয়ে এগিয়ে যায় প্রতিবাদী মিছিল। আবাহনী মাঠের সামনে থেকে যাত্রা শুরু করে প্রতিবাদী গানের মিছিল ধানমন্ডি ১২/এ সড়ক দিয়ে মাঠের দক্ষিণ ও পূর্ব দিক প্রদক্ষিণ করে ১৪/এ সড়ক হয়ে ২৭ নম্বর সড়ক দিয়ে ঘুরে আবার সাতমসজিদ রোডের যাত্রাবিন্দুতে ফিরে আসে। গান গেয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলার সময় আগ্রহী অনেকেই এই প্রতিবাদে শামিল হয়ে মিছিলে অংশ নেন।

জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হয়েছিল পদযাত্রা, পথপরিক্রমার পর আবার সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা দিয়েই শেষ হয় এই প্রতিবাদী আয়োজন।