কয়েকজন মানুষের উৎসাহ, আগ্রহ আর নিষ্ঠার কারণেই আবার খুঁজে পাওয়া এবং সফলভাবে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে ১৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ফুটি কার্পাসের। বন্য প্রজাতির এই তুলার বৈজ্ঞানিক নাম গসিপাস আরবোরিয়াম। একসময়ে মূলত মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার অববাহিকায় হতো। এই তুলাই ইতিহাসবিশ্রুত মসলিনের মূল উপাদান।
সরকারি সহায়তা এবং বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কেবল ফুটি কার্পাস উৎপাদনই নয়, সফলভাবে কাটুনি তৈরি ও মিহি কাউন্টের সুতা কাটার পর সেই সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি সম্ভব হয়েছে। মসলিনের পুনরুজ্জীবন বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা। মসলিন ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের সনদ পেয়েছে আগেই। তবে মসলিনের মূল উপাদান ফুটি কার্পাস তুলা, এর বীজ ও গাছকে এই সনদ দেওয়া হয়েছে গত ৩০ এপ্রিল। ঢাকাই ফুটি কার্পাস তুলা এবং ঢাকাই ফুটি কার্পাস তুলার বীজ ও গাছ আলাদাভাবে এই সনদ পেয়েছে।
তা ছাড়া একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আরও ২২টি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের সনদ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের জামুর্কির সন্দেশ, নরসিংদীর লটকন, মধুপুরের আনারস, ভোলার মহিষের দুধের কাঁচা দই, মাগুরার হাজরাপুরী লিচু, সিরাজগঞ্জের গামছা ও লুঙ্গি, সিলেটের মণিপুরি শাড়ি, মিরপুরের কাতান শাড়ি, কুমিল্লার খাদি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি, গোপালগঞ্জের ব্রোঞ্জের গয়না, সুন্দরবনের মধু, শেরপুরের ছানার পায়েস, গাজীপুরের কাঁঠাল, কিশোরগঞ্জের রাতা বোরো ধান, অষ্টগ্রামের পনির, বরিশালের আমড়া, কুমারখালীর বেডশিট, দিনাজপুরের বেদানা লিচু, মুন্সিগঞ্জের পাতক্ষীর ও নওগাঁর নাক ফজলি আম।
একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ মণিপুরি শাড়ি ও মিরপুরের কাতান শাড়ির বয়নপদ্ধতি পরিযায়ী পরিস্থিতি থেকে আমাদের এই মাটির হয়ে গেছে। কাতান শাড়ি বেনারস থেকে আসা বয়নশিল্পীরাই বুনে থাকেন। তবে এর উদ্ভাবন ভারতে নয়। তা ছাড়া বেনারসির সঙ্গে এর সূক্ষ্ম পার্থক্যও আছে। অন্যদিকে মণিপুরি শাড়ি আমাদের দেশেরই উদ্ভাবন। আর সেটা হয়েছে সম্ভবত আশির দশকে বাঙালিদের উৎসাহে। কারণ, মণিপুরি শাড়ি মণিপুরি সম্প্রদায়ের পোশাক নয়।
এখানেও আরও একটা বিষয় বিবেচ্য, ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে মুসলমান বয়নশিল্পীদের অভিবাসনের সঙ্গে ভারত ভাগের সম্পর্ক রয়েছে। ভারত ভাগের আগে, পরে এবং ওই সময়েই তাঁরা এসেছেন। অন্যদিকে মণিপুরিদের অভিবাসনের সঙ্গে ভারত ভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা এসেছেন ৩০০ বছর আগে।
এই দুইয়ের পাশাপাশি একটা কাপড় ব্র্যান্ডে পরিণত হলেও এর পরিস্থিতি আগের মতো নেই; জিআই পাওয়া এই কাপড় হলো কুমিল্লার খাদি। তবে এই সনদ কুমিল্লার খাদির সুদিন কতটা ফেরাতে সক্ষম হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও বার্ড (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) খাদির অবস্থা বদলাতে একটি প্রকল্প নিয়েছে।
কাপড়ের তালিকায় আরও আছে সিরাজগঞ্জের গামছা ও লুঙ্গি এবং কুষ্টিয়ার বেডশিট। ১৮০৯ সাল থেকে গামছা ব্যবহারের উল্লেখ থাকলেও লুঙ্গির উৎপত্তি নিয়ে তেমন কোনো বিবরণ নেই।
কুষ্টিয়ার বেডশিটশিল্পের সূচনা করেন মোহিনী মোহন চক্রবর্তী, যিনি ১৯০৮ সালে আটটি তাঁত নিয়ে মোহিনী মিল প্রতিষ্ঠা করেন। কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে রেলস্টেশন, নদীবন্দর ও বড়বাজারের সন্নিকটে মিলটি দ্রুত লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়। ফলে সে বছরই ১০০ একর জায়গার ওপর ছড়িয়ে যায় পুরো মিলটি। ১৯১০-১৮ সালের মধ্যে ইংল্যান্ড থেকে পিতলের হ্যান্ডলুম ও প্রায় ২০০ তাঁত আমদানি করে মিলের উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো হয়।
গোপালগঞ্জে প্রায় ১০০ বছর ধরে তৈরি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ব্রোঞ্জের গয়না, যা এবার ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি পেয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, শিশুর অবস্থান শনাক্তে তাদের পায়ে ঘণ্টাযুক্ত ব্রোঞ্জের খাড়ু পরানো হতো, যেখান থেকে গয়না তৈরির সূচনা। সময়ের সঙ্গে খাড়ুর পাশাপাশি কারিগরেরা তৈরি করছেন নানা রকম ব্রোঞ্জের গয়না।
এবার আছে একাধিক মিষ্টি। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের জামুর্কির সন্দেশের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। এ সন্দেশ উদ্ভাবনের নেপথ্যে আছেন স্থানীয় মদনমোহন সাহা। ১৯৪০ সাল উদ্ভাবিত এই সন্দেশ ৮৫ বছর আগে বংশপরম্পরায় টিকে আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টির সুখ্যাতির পেছনে আছে কাশী থেকে আসা মহাদেব পাঁড়ে। কলকাতায় মিষ্টি তৈরিতে দক্ষতা অর্জনের পর নানা জায়গা ঘুরে এক শতাব্দী আগে তিনি আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। শহরের মেড্ডায় শিবরাম মোদক তাঁকে আশ্রয় দেন এবং পরে নিজের মিষ্টির দোকান তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। মহাদেবের তৈরি ‘ছানামুখী’ মিষ্টি থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
মোগল আমলে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের দত্তপাড়ায় হাওরের গবাদিপশুর দুধ থেকে পনির তৈরির প্রথা শুরু। প্রায় ৩০০–৩৫০ বছর আগে তৈরি হওয়া এই পনির গুণ, মান ও বর্ণে দ্রুত পরিচিতি পায় সারা দেশে, এমনকি একসময় ইউরোপের বাজারেও সমাদৃত হয়।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের সন্তোষপাড়ায় প্রায় ২০০ বছর ধরে পাতক্ষীর তৈরির ঐতিহ্য চলে আসছে। মোগল আমলেই ঢাকায় এর জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, পুলিন বিহারী দেব ও তাঁর স্ত্রী প্রথম পাতক্ষীর তৈরি শুরু করেন, পরে ইন্দ্রমোহন ও লক্ষ্মী রানী ঘোষও এতে যুক্ত হন। বর্তমানে তাঁদের বংশধরেরাই এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।