প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লেখা

অনুসন্ধান: ঘটনার পেছনের সত্য

নরসিংদীতে ২০ বছরে দেড় হাজারের বেশি মানুষ খুন হয়েছেন—এটা কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই মৃত্যুর ভেতরে লুকিয়ে আছে রাজনীতি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, জমি দখল, আধিপত্য আর ক্ষমতার সংঘাতের নির্মম ভূচিত্র। খুনের ঘটনা সংবাদ হিসেবে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অনুসন্ধান দেখায়—কেন বারবার খুন হয়, কেন একই পরিবার পাঁচ দশক পরেও হত্যার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, কেন এই জেলার সমাজকাঠামোয় খুনের পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকে। 

 ‘রাজনীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুনোখুনি’ শিরোনামে গত ২৮ জুন প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে একটি জনপদের সমাজ ও রাজনীতির ‘ডার্ক ডেটা’র রেখাচিত্র বেরিয়ে আসে। 

প্রথম আলোর অনুসন্ধানের অনেক উদাহরণ রয়েছে—যেখানে শুধু ঘটনা জানানো হয়নি; বরং ঘটনার নিচের স্তর চিহ্নিত করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথের ঠিকাদারির কাজ ঘুরেফিরে পেয়ে আসছিলেন তখনকার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠ পাঁচ ঠিকাদার। এ বিষয়ে প্রথম আলো কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি করে। এমনকি সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালায় বড় ধরনের সংশোধন আনা হয়। একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন কখনো কখনো সরকারের নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে—এ উদাহরণ তার একটি বাস্তব প্রমাণ। 

ধর্ষণের ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন—এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। বিয়ের মধ্য দিয়ে ধর্ষণ মামলার ‘মীমাংসা’ও হয়েছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসেছে—এ ধরনের মীমাংসার করুণ পরিণতি প্রায়ই নির্যাতন, বিচ্ছেদ বা মৃত্যু। 

এ জায়গাটাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার শক্তি। ঘটনার বিবরণই শেষ কথা নয়—প্রশ্ন হলো, তার পেছনে কী আছে? 

পাঠকেরা কেবল দিনের খবর জানার জন্য নয়, ঘটনার গভীরে থাকা সত্যের সন্ধান পাওয়ার জন্যও প্রথম আলোর কাছে আসেন। প্রথম আলোরও পাঠকের প্রতি এটি একটি অঙ্গীকার। আর সেই অঙ্গীকার বাস্তব রূপ পায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়। 

ইতিহাসের ভেতরে মৃত্যু গণনা

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকালে প্রথম আলো সাহসিকতার সঙ্গে বিস্তৃতভাবে তথ্য সংগ্রহ করে মানুষের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেছে। এরই ধারাবাহিকতা গণ–অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় আবার অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। সরকারি গেজেটে শহীদদের তালিকায় যে ৮৪৪ জনের নাম এসেছে, তাঁদের মধ্যে ৮১০ জনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে প্রথম আলো ২০ জুলাই প্রতিবেদন ছাপিয়েছে—‘সবচেয়ে বেশি মৃত্যু শ্রমজীবীদের’। 

এই অনুসন্ধান এখন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

দ্য টাইমসের সঙ্গে যৌথ অনুসন্ধান

যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এর সঙ্গে ‘টিউলিপ এখনো বাংলাদেশের ভোটার, আছে পাসপোর্ট, এনআইডিও’ শিরোনামে প্রকাশিত যৌথ অনুসন্ধানে উঠে আসে—ব্রিটিশ সংসদ সদস্য টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের নাগরিক। যদিও তিনি তা অস্বীকার করে আসছিলেন। প্রথম আলো নথিপত্র অনুযায়ী তথ্য যাচাই করে আরেকটি অনুসন্ধান প্রকাশ করে—‘টিউলিপ বাংলাদেশের করদাতাও ছিলেন’। এই অনুসন্ধান বাংলাদেশের বাইরেও যুক্তরাজ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। 

আরও উদাহরণ

বিরল রোগ নিয়ে প্রথম আলো প্রকাশ করেছে বিস্তারিত প্রতিবেদন—যেখানে দেশজুড়ে আক্রান্ত মানুষের তথ্য, সহায়তা–কাঠামোর ঘাটতি এবং অদেখা বাস্তবতার চিত্র উঠে আসে। 

অনুসন্ধানে এসেছে—বিগত সরকারের আমলে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই বন্ধুরা’ কীভাবে প্রিপেইড মিটার কেনার কাজ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। 

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সময়সাপেক্ষ, কখনো ঝুঁকিপূর্ণও। প্রথম আলো শুরু থেকেই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে—এটা পাঠকের প্রতি দায়িত্ব মনে করে। রাজনীতি, সমাজ, ক্ষমতার গোপন বলয়, আইনের ফাঁকফোকর, প্রশাসনিক প্রভাব—সবচেয়ে কঠিন স্তরেও গিয়ে তথ্য খুঁজে আনা—এই সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতাই প্রথম আলোকে পাঠকের আস্থার সবচেয়ে বড় জায়গায় দাঁড় করিয়েছে।

টিপু সুলতান: হেড অব পলিটিকস অ্যান্ড ক্রাইম