বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে তাবাসসুম। তাবাসসুম মাইলস্টোনের সপ্তম শ্রেণির আর ভাই তানভীর কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী
বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে তাবাসসুম। তাবাসসুম মাইলস্টোনের সপ্তম শ্রেণির আর ভাই তানভীর কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী

সহপাঠীদের পুড়তে দেখে ট্রমায় শিশুরা

‘বাবা, ওদিকে যাব না, বিল্ডিংটা দেখলে ভয় লাগে!’

বিল্লাল হোসেন ও তানিয়া আক্তারের দুটি সন্তান। দুজনই রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। মেয়ে তাবাসসুম পারভীন সপ্তম শ্রেণিতে আর ছেলে তানভীর হোসেন আবদুল্লাহ কেজিতে। আজ রোববার স্কুলের প্রধান ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, বিল্লাল হোসেন দুই সন্তানকে নিয়ে কাউন্সেলিং সেন্টারের বারান্দায় হাঁটছিলেন। কাউন্সেলিং সেন্টারটি গড়ে তোলা হয়েছে মূল ফটক থেকে ঢুকতে ডান দিকের একতলা একটি ভবনে। এই ভবন পেরিয়ে সোজা কিছুটা বাঁয়ে গেলে ডান দিকে হায়দার আলী ভবন, যেখানে ২১ জুলাই বেলা একটার পর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল।

এই প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মেয়েটা বাসায় বসে সারা দিন কাঁদে, তাই ওকে কাউন্সেলর দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম। গত শনিবার ওর বন্ধু জারিফ ফারহান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। ওরা দুজন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে।’

আজ স্কুলে গিয়ে কাউন্সেলিং সেন্টারের একটি কক্ষে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখা যায়। মেঝেতে থরে থরে ব্যাগ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাগের হাতলে শিশুদের নাম, রোল নম্বর, শ্রেণি ও শ্রেণি শাখার নাম লেখা কাগজ সাঁটিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে আতঙ্কে ব্যাগগুলো ফেলে ছোটাছুটি করছিল শিশুরা।

সেই ব্যাগগুলোর একটি জাফিরা বাশারের। মা রিফাত ফেরদৌসের সঙ্গে ব্যাগ নিতে এসেছিল সে। তাকে খুব বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। মা রিফাত জানালেন, তাঁর মেয়ের বন্ধু আয়মান মারা গেছে। আয়মানের হাত ধরে সেদিন বিদায় জানিয়েছিল জাফিরা।

কাউন্সেলিং সেন্টারের একটি কক্ষে মেঝেতে থরে থরে ব্যাগ সাজিয়ে রাখা হয়েছে

চতুর্থ শ্রেণির কাকাতুয়া শাখার তাসনিম আফরোজ আয়মান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শুক্রবার সকালে মারা যায়। একই শাখার ছাত্রী জাফিরা। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল জাফিরার মা রিফাত ফেরদৌসের। তিনি বলেন, ‘মেয়েটা ঘুমের মধ্যেও বন্ধু, আগুন এসব স্বপ্ন দেখে। চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে ইউটিউবে এটা–সেটা দেখত। এখন সেসব দেখতেও আগ্রহ দেখায় না।’ স্কুল থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে মেয়েকে মানসিক সহায়তা দিতে কাউন্সেলিং নেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। সেদিন আয়মানকে বিদায় জানিয়ে জাফিরা আমার কাছে চলে এল। আর আয়মান ভবনের ভেতরে চলে গেল। তখনো ওর বাসা থেকে কেউ নিতে আসেনি। শুনেছি, ওর বাসা থেকে গাড়িচালক নিতে আসবেন।’

কথা বলার এক পর্যায়ে দুই শিশুসন্তান নিয়ে আসেন সাইফুর রহমান নামের এক বাবা। তাঁর মেয়ে সামিয়া আক্তারও আয়মানের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে এমন একটি ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে, তাঁরাও চেষ্টা করছেন মেয়েকে মানসিক সহায়তা দিতে।

মাকে সঙ্গে করে স্কুলব্যাগ নিতে এসেছিল জাফিরা বাশার  

‘বাবা, ওদিকে যাব না’

স্কুলের তালিকা অনুসারে, এখন পর্যন্ত জারিফসহ শুধু সপ্তম শ্রেণির অ্যালামান্ডা শাখার সাত শিক্ষার্থী মারা গেছে। তৃতীয় শ্রেণির ক্লাউড শাখার পর এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যু। ক্লাউড শাখার সর্বোচ্চ আট শিশু মারা গেছে।

বাবা বিল্লাল হোসেন কথা বলার সময় পাশে বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়েছিল তাবাসসুম। সোয়েটার কারখানার মালিক বিল্লাল হোসেনের বাসা স্কুলের পাশেই। বেশির ভাগ সময় তিনি ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে আনা–নেওয়া করেন। বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ছেলের আধঘণ্টা আগে ছুটি হয়। ওকে নিয়ে মেয়েকে আনার জন্য যাই। মেয়ে বেরিয়ে আসামাত্রই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মেয়ে বুকে ব্যথা পেয়েছিল। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। একদিন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। সহপাঠীদের পুড়তে দেখেছে। মেয়ের মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। কাউন্সেলর বলেছেন, ওকে সময় দিতে।’

কথা শেষ করে তিনি মেডিকেল টিমের খোঁজে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিমান বিধ্বস্ত হওয়া হায়দার আলী ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়ায় তাবাসসুম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘বাবা, ওদিকে যাব না।’ বাবা আসার অনুরোধ জানালে সে বলে ওঠে, ‘বাবা, প্লিজ চলে এসো। বিল্ডিংটার দিকে তাকালে ভয় লাগে। আমার ভালো লাগে না।’ সে তখন ভীত চোখে পোড়া ও বিধ্বস্ত দোতলা ভবনের দিকে তাকাচ্ছিল। একপর্যায়ে বাবা তাকে অভয় দিয়ে নিয়ে যান।

‘বাবা, ওদিকে যাব না।’ বাবা আসার অনুরোধ জানালে সে বলে ওঠে, ‘বাবা, প্লিজ চলে এসো। বিল্ডিংটার দিকে তাকালে ভয় লাগে। আমার ভালো লাগে না।’
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবাসসুম

স্কুলের কয়েকজন ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হায়দার আলী ভবনটি ছিল তিনতলা। নিচু জায়গা হওয়ায় মাটি ফেলতে ফেলতে একসময় নিচতলাটিকে মাটির সমতল করে ফেলা হয়। ফলে ভবনটির ভিত্তি ছিল শক্ত। এটি আগে হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পুরো ভবনটি রডের গ্রিল দিয়ে ঘেরা। শুধু মাঝখানে ঢোকা ও বের হওয়ার একটিমাত্র প্রবেশপথ। যখন হোস্টেল ছিল, তখন বাইরের দিকে একটি লোহার সিঁড়ি ছিল। স্কুল ভবন করার পর সেই সিঁড়িটি তুলে ফেলা হয়। ফলে সিঁড়ির পাশের কক্ষে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যাওয়ার পর ওই একমাত্র প্রবেশপথটি ব্যবহারের কোনো উপায় ছিল না। ভবনের ভেতরে যাঁরা ছিলেন, কার্যত তাঁরা আটকা পড়েন।

মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন নামে স্কুলের ইংরেজি শাখার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বারান্দার বাঁ পাশের গ্রিলের একটি অংশ ভেঙে কয়েক শিশুকে নিয়ে গাছ বেয়ে নেমে আসেন। পরে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল এসে বারান্দার অপর পাশে (ডান দিকে) আরেকটি গ্রিল ভেঙে আটকে পড়া শিশুদের নামায়। পাশের একটি লোহার গেট খুলে স্লাইডিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।

ভবনের এই দিকের গ্রিল ভেঙে কয়েক ছাত্রকে নিয়ে বের হয়েছিলেন স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন। জায়গাটি এই প্রতিবেদককে দেখাচ্ছেন তিনি

সপ্তম শ্রেণির অ্যালামান্ডা শাখার ছাত্র সূর্য সময় বিশ্বাস আহত বাবাকে নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ভুগছে বলে জানিয়েছেন মা শারমিন ইসলাম। তিনি মাইলস্টোন কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। স্বামী মুকুল বিশ্বাস ব্র্যাকের এরিয়া ব্যবস্থাপক হিসেবে সিয়েরা লিওনে কর্মরত। তিনি সম্প্রতি দেশে এসেছেন। ঘটনার দিন ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে বিধ্বস্ত বিমানের ছুটে আসা তামার অংশের আঘাতে আহত হন।

শারমিন বলেন, তাঁর ছেলে বন্ধুদের নিয়ে গ্রিলের ভাঙা অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসে। ঘটনার দুই দিন পর্যন্ত সে বারবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘মা, বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো!’ তিনি বলেন, ‘ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখেছি, সূর্য কার্নিশে দাঁড়িয়ে আগে বন্ধুদের নামতে দিয়েছে। ছেলেকে যে শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি, তার যথাযথ ব্যবহার করে জাতিকে দেখাল। ছেলে যেন মানবিক মানুষ হয়, সেটাই চেয়েছিলাম।’

মাইলস্টোন কলেজের উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মো. মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকেরা নিহত পরিবারের স্বজন ও আহতদের দেখতে নিয়মিত হাসপাতালে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত স্কুলের ২৬ শিশু, ৩ অভিভাবক, ২ শিক্ষক, একজন কর্মচারীসহ মোট ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এর বাইরে পাইলটের নাম যোগ করে মৃতের মোট সংখ্যা ৩৩ জন বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চিকিৎসাধীন ৪৬ জন।

বারান্দার এ পাশের গ্রিল ভেঙে শিক্ষার্থীদের বের করে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল

সরকারি ব্যবস্থা

মাইলস্টোনের আহত শিশুদের মানসিক সহায়তা দিতে একটি পথনকশা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আগামীকাল সোমবার দুপুর ১২টায় এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে সরকার থেকে ইতিমধ্যে মানসিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (হাসপাতাল শাখা) মুস্তাফিজুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঘটনার পরদিন ২২ জুলাই থেকে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে মাইলস্টোনের শিশুদের জন্য বিশেষ বহির্বিভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫টি কেবিন ও ৭টি শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে এক শিশু সেখানে ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি স্বাস্থ্যসেবা কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেসব হাসপাতালে স্কুলটির আহত শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা ভর্তি রয়েছেন, সেসব হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন কমিটির চিকিৎসকেরা। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ট্রমা কাউন্সিল, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ব্র্যাক থেকে তিন দিনে তিনটি দল মানসিক সহায়তা দিয়েছে চিকিৎসাধীনদের।

আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের দোতলা থেকে বের করে আনতে লোহার এই ফটক খুলে নিয়ে স্লাইডিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়

শোক প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে

মনোরোগবিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে শিশুদের ট্রমা কাটাতে মা–বাবাসহ পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকদের সহায়তা দিতে হবে। পরিবারে শিশুদের ঘুম, খাওয়াদাওয়াসহ প্রাত্যহিক কাজ যেন ঠিক রাখা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। তাদের শোক প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। তাদের মন খারাপ করে থাকাকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিতে হবে। শিশুদের মানসম্মত সময় দিতে হবে, ক্যারম, লুডু ইত্যাদি খেলার সঙ্গী হতে হবে। আর স্কুল কর্তৃপক্ষের এখন উচিত হবে, ধীরে ধীরে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করা। যে ভবনটিতে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটিকে মেরামত করে কোনো একটি অংশে নিহত শিশুদের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো মিলনায়তন করা বা স্মৃতিস্মারক স্থাপন করা উচিত। এতে করে শিশুদের মনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এমন শিশুদের সাক্ষাৎকার নেওয়া থেকে সাংবাদিকদের বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ঘটনার বর্ণনা শিশুর অভিভাবকের কাছ থেকে শুনে নেওয়া ভালো।