
ক্যানসারে আক্রান্ত হলে প্রথমেই যে ধাক্কাটি লাগে, তা মানসিক। রোগী ও রোগীর পরিবারের কাছে এটা একটা বড় রকমের আঘাত হয়ে আসে। অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বিপন্নবোধ করেন। অনেকে রোগের কথা গোপন রাখতে চান। কিন্তু এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটাই সব থেকে জরুরি। এ জন্য মনের শক্তির সঙ্গে প্রয়োজন বাস্তবতাকে সহজভাবে গ্রহণ করে সবাই মিলে উত্তরণের চেষ্টা করা। ক্যানসার মানেই থেমে যাওয়া নয়।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার কথা এভাবেই বলেছেন ক্যানসার যোদ্ধারা। দেশের বিভিন্ন পেশার ক্যানসার আক্রান্ত মানুষ তাঁদের চিকিৎসা, রোগের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে প্রতিদিনের জীবনযাপন, পেশাগত কাজ, অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা বলেছেন অনুপ্রেরণাময় ভাষায়। আজ রোববার বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আয়োজনটি চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ওসমান জামিল মিলনায়তনে।
ক্যানসার আক্রান্তদের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ক্যানসার কেয়ার ফাউন্ডেশন (সিসিসিএফ) ও চারুকলা অনুষদ ক্যানসার সারভাইভার দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ১২ জন ক্যানসার সারভাইভার্সকে সম্মাননা জানানো এবং সিসিসিএফের ওয়েবসাইটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
প্রধান অতিথি ছিলেন জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হালিদা হানুম আখতার। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী আবুল হায়াত ও জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এস এম শহীদুল্লাহ। সভাপতিত্ব করেন সিসিসিএফের সভাপতি ক্যানসার সারভাইভার রোকশানা আফরোজ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে প্রয়াতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সারভাইভারদের ফুল ও ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। তাঁরা হলেন অভিনয়শিল্পী আবুল হায়াত, কৃষিবিদ মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, সমাজসেবী নীলুফার তাসনিম, চিকিৎসক ও সমাজসেবী সেতারা রহমান, উদ্যোক্তা নাসরিন বানু, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রীনা রানী পাল, উপস্থাপক সামিয়া আফরিন, চিত্রশিল্পী তৈয়বা বেগম, রুমানা আহমেদ, কবি প্রত্যয় জসিম, নারী সংগঠন নারীপক্ষের সভাপতি গীতা দাস ও সংগঠক ফারজানা হাফিজ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জাহান ই গুলশান। এই অনুষ্ঠানে কেবল প্রধান অতিথি ছাড়া সবাই ছিলেন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ফেরা।
সম্মাননা শেষে আবুল হায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়েবসাইটটি উদ্বোধন করেন। এরপর সারভাইভাররা তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে হালিদা হানুম আখতার বলেন, ক্যানসার প্রতিরোধের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিরোধের বিষয়ে জোর দিতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসা সহজ হয়। নিরাময়ের সম্ভাবনাও অনেক বাড়ে। এ ক্ষেত্রে আক্রান্তদের অভিজ্ঞতা অন্যদের সচেতন করতে পারে। সিসিসিএফের এই উদ্যোগ সে লক্ষ্য অর্জনে বড় অবদান রাখতে পারে।
আবুল হায়াত রোগনির্ণয়ের পর তাঁর নিজের ও পরিবারে প্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা বর্তমানের জীবনযাপন এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। তিনি বলেন, দেশেই চিকিৎসা করছেন। দেশের চিকিৎসার প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা আছে। চিকিৎসক তাঁকে বলেছেন, মনোবল অটুট রাখতে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে। সেভাবেই তিনি চলছেন। নিয়মিত অভিনয় করছেন। জানালেন, গত মাসে প্রতিদিন তিনি শুটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে এসে অন্য সারভাইভারদের কথা শুনে মনে হয়েছে সবাই একেক জন যোদ্ধা। তাঁদের কথায় নিজে আরও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মনের জোর আরও বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এস এম শহীদুল্লাহ বলেন, অনেকে ক্যানসার আক্রান্ত হলে গোপন রাখতে চান। কিন্তু আক্রান্তরা যদি খোলামেলাভাবে সবাইকে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন, তবে উপকৃত হবেন। চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সিসিসিএফের এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।
উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিসিসিএফের সভাপতি রোকশানা আফরোজ বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা এই কথাটিই সবাইকে বলতে চাই যে ক্যানসার মানেই থেমে যাওয়া নয়। ক্যানসার নিয়েও কাজ করে চলেছেন, এমন অনেক মানুষ আমাদের মধ্যেই আছেন।’ তিনি বলেন, সবচেয়ে ভালো হবে ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারলে। সিসিসিএফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিজে নিজে স্তন ক্যানসার পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমেে আবাসিক হল এবং বিভাগভিত্তিক সব ছাত্রীকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার আক্রান্তদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করা হবে। তিনি সরকারিভাবে জাতীয় ক্যানসার তহবিল গঠনের আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ডা. পল ম্যনওয়ারিং ও জিংক টেকনোলজিস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক শাহিদ।