
দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব নেত্রকোনার কলমাকান্দা অঞ্চলের গারো সম্প্রদায়ের বাসিন্দা রিশা তাড়ি ঘাগরার জীবন–গল্প।
আমি রিশা তাড়ি ঘাগরা। বেড়ে উঠেছি নেত্রকোনায়, কলমাকান্দা অঞ্চলের গারো সম্প্রদায়ে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার প্রথম পিরিয়ড বা মাসিক হয়। ওই বয়সে বুঝে উঠতে পারিনি—মাসিক মেয়েদের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যদিও আমার মা আমাকে এই বিষয়ে অবহিত করেছিল। কিন্তু হোস্টেলে থাকা অবস্থায় আমাকে কেউ বলেনি যে মাসিক কী? কিংবা মাসিক হলে কী করতে হয়।
সত্যি বলতে, সেই সময় আমার চারপাশের পরিবেশ বা আত্মীয়স্বজনেরা এই বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতেন না। তাই আমার প্রথম মাসিকের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। হোস্টেলের বড় আপুদের সহযোগিতায় আমি কিছুটা সামলাতে পেরেছিলাম। কিন্তু ট্রমা কাটতে অনেক সময় লেগেছে।
এখনো কিন্তু আমাদের দেশে মাসিক নিয়ে সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবারে প্রকাশ্যে কথা বলা হয় না। বিশেষ করে গ্রামে অনেকেই ভাবেন, মাসিক হচ্ছে মেয়েদের একটা অসুখ। আমি এখন কর্মসূত্রে বরগুনার পাথরঘাটায় থাকি, ব্র্যাকের ওয়াশ (WASH) প্রোগ্রামে কাজ করি। আমি স্কুল এবং মাদ্রাসায় মেয়েশিক্ষার্থীদের মাসিক নিয়ে সচেতন করতে গিয়ে এমন অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।
বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষকেরা খোলাখুলি কথা বলতে চান না, ভাবেন মাসিক বা পিরিয়ড একটা ‘মেয়েলি রোগ’। এটি যে একটি মেয়ের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়—তা উপলব্ধি করতে পারেন না। আমার সঙ্গে অধিকাংশ সময় সংকোচ নিয়ে কথা বলেন। অনেক সময় নারী–শিক্ষকের মাধ্যমে কথা বলেন। এসব আচরণের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি, আমাদের সাধারণ সমাজব্যবস্থায় এখনো মেয়েদের মাসিক নিয়ে অনেক কুসংস্কার বা ভুল ধারণা আছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাসিকবান্ধব না হলে নারীশিক্ষার কত বড় ক্ষতি হয়—তা এখনো বুঝে উঠতে পারে না অনেকেই। আমার শৈশবের ভয়াবহ স্মৃতি আমাকে এই সচেতনতামূলক কাজে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। আমি যখন এই কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করি, কৈশোরের স্মৃতি আমাকে উৎসাহিত করে। আমি জানি, মাসিকের সময় একটি মেয়ের শরীর আর মনে কী ধরনের পরিবর্তন আসে। ভীতি কীভাবে কাজ করে। শহুরে তরুণীরা কিছুটা সচেতন হলেও এখনো গ্রামের কিশোরী–শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে ততটা সচেতন নয়।
কাজের শুরুতে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। প্রথমত, আমি গারো সম্প্রদায়ের বলে অনেকেই আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। একটু দ্বিধা ছিল। আমার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করত। ছাত্রীদের সচেতনতার জন্য সেশনের অনুমতি নিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। দিনের পর দিন অনুমতির অপেক্ষা করেছি। অনেকভাবে অপমানিত হয়েছি কিন্তু দমে যাইনি। ধৈর্য আমাকে ফলাফল দিয়েছে। আমি যখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে কথা বলি, করণীয় বিষয় সম্পর্কে সহজ করে বোঝাই, তখন শিক্ষক বা স্কুল কমিটি বুঝতে পারে এর গুরুত্ব। বিশেষ করে নারী শিক্ষকেরা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। কারণ, তাঁদের সময় কেউ এ রকমভাবে সচেতন করেনি।
আমি শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বোঝাই। এ সময় কীভাবে স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে, কতটুকু পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, স্যানিটেশন প্যাড কীভাবে ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি বিষয় সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। গ্রামের অনেকই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না, কিন্তু কাপড় ব্যবহার করলে কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে বলি। মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ‘অনন্যা’ নামে একটি অ্যাপ আছে, এই অ্যাপের সাহায্যে কীভাবে খুব সহজেই মাসিককালীন এবং পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হয়, তা হাতে-কলমে শেখাই। পাশাপাশি প্রচলিত অনেক কুসংস্কার বা ভুল ধারণার জবাব দিই।
এভাবে খোলামেলা আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অন্য রকম সম্পর্ক হয়ে যায়। যখন কোনো মেয়ে বলে, ‘আপু, এখন আমি বুঝি আমার শরীরে কী পরিবর্তন হচ্ছে’, তখন মনে হয়, আমার কাজটা সার্থক। স্কুলের সীমানা পেরিয়ে অনেকের বাড়িও যাই। মা-মেয়ের খোঁজ নিই। অ্যাপ ব্যবহার করে মাসিক ট্র্যাকিং করতে পারছে কি না, তা জানার চেষ্টা করি। আমাকে অভিভাবকেরা আপন করে নেয়। তাঁদের মাসিক স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়েও কথা বলেন।
অনেক বাধা পেরিয়ে আমি যখন কয়েক মাস পার করি, তখন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে থাকি। মাসিক হওয়ার কারণে স্কুলে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত হয় না। শিক্ষক আর অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। আমাকে সাদরে গ্রহণ করতে থাকে সবাই।
মেয়েদের হাসিমাখা মুখগুলো যখন দেখি, তখন অতীতের সব অপমান ভুলে যাই। আমি যে স্বজন থেকে দূরে আছি, তা–ও মনে থাকে না। দেশের প্রান্তিক এলাকায় সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের যে আমি কিছু জরুরি বার্তা দিতে পারছি—এটাই আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া।
মেয়েদের মাসিক নিয়ে আমাদের সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি, বিশেষ করে পুরুষদের। একজন নারীর বেড়ে ওঠার পেছনে পুরুষ সহকর্মী, অভিভাবক ও শিক্ষকের ভূমিকা অনেক বেশি। এঁদের সঙ্গে নিয়েই তো নারী এগিয়ে যান। নারী চলার পথে যদি পুরুষের সহযোগিতা আর সহমর্মিতা পান, তাহলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। একজন সুস্থ নারীই দেশ এবং পরিবার গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন।
তাই আমার আশা, বাংলাদেশে আর কোনো মেয়ে যেন মাসিক নিয়ে অজানা বা ভয়ের মধ্যে না থাকে। সবাই যেন এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারে।
(অনুলিখন)