নদের জমি বেচছেন কৃষক লীগ নেতা

কুড়িগ্রামের চাকিরপশার নদের ৩৪ একর জমি দখল করে কৃষি খামার করেছিলেন স্থানীয় কৃষক লীগের নেতা ইউনুছ আলী। সম্প্রতি তিনি এই জমি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছেন। গত ২২ ডিসেম্বর রাজারহাটের পাঠানপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

২০২০ সালে কুড়িগ্রামের চাকিরপশার নদের ২২ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা করে জেলা প্রশাসন। সেই তালিকা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে পাঠিয়ে বলা হয়েছিল, দখলদারদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। কিন্তু দুই বছর পর দেখা গেল, দখল উচ্ছেদ তো হয়নি, উল্টো নদের জমি এখন বেচাকেনা হচ্ছে।

চাকিরপশার নদটি মূলত তিস্তা নদীর উপনদ। এটি বুড়িতিস্তা নদীর উজানের অংশ। নদটির উৎপত্তিস্থল রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়ি নামক নিম্নাঞ্চল থেকে।

স্থানীয় লোকজন জানান, চাকিরপশারের প্রস্থ কোথাও কোথাও ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। ২৫-৩০ বছর আগেও এ নদের পানি গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পড়ত। এখন এ নদ উলিপুর উপজেলার থেতরাইয়ে তিস্তা নদীতে গিয়ে মেশে।

নদপারের বাসিন্দাদের অভিযোগ, একসময়ের খরস্রোতা চাকিরপশার নদের জমির বড় অংশটি দখল হয়ে গেছে। নদে অর্ধশত পুকুর করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। এক একটি পুকুর ৫ থেকে ২৫ একর আয়তনের।

স্থানীয় কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজারহাটের মীর ইসমাইল হোসেন কলেজের বিরুদ্ধেও নদের জমি দখল ও পুকুর বানানোর অভিযোগ রয়েছে।

২০২০ সালের ১২ আগস্ট প্রথম আলোয় চাকিরপশার নদের দখলচিত্র নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

জেলা প্রশাসনের করা ওই তালিকায় নদের দখলদারদের মধ্যে রয়েছেন রাজারহাটের বিএনপি নেতা ও সাবেক উপজেলা পরিষদদের চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহর ছেলে আহসান হাবীব, সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির নেতা পনির উদ্দিনের ছেলে বাবলু মিয়া, বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দী, উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মেজর (অব.) ইউনুছ আলী প্রমুখ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজারহাট সদর ইউনিয়নের পাঠানহাটে চাকিরপশার নদের ৩৪ একর জমিতে ছয়টি পুকুর তৈরি করেন উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ইউনুছ আলী। এই জমিতে প্রাচীর দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন কৃষি খামার। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইউনুছ আলী সম্প্রতি নদের এসব জমি বিক্রি করেছেন।

জানা গেছে, ২০১০ সালে বেসিক ব্যাংকের রংপুর শাখা থেকে এই জমি দেখিয়ে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বন্ধকি ঋণ (মর্টগেজ) নেন ইউনুছ আলী। এখন বেসিক ব্যাংক ও ইউনুছ আলী উভয়ের সম্মতিতেই এই জমি বিক্রি করা হচ্ছে।

ইউনুছ আলীর ভাষ্যমতে, তিনি ২ কোটি ৭৫ টাকা মূল্যে এই জমি বিক্রি করেছেন সাফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে। কিন্তু নদের জমি বিক্রি করলেন কীভাবে, জানতে চাইলে ইউনুছ আলী বলেন, ‘এটা নদীর জমি কি না জানি না। এটি বিলশ্রেণির ছিল। আমি এগুলোর মালিক।’

তবে স্থানীয় জেলে আবুল কালাম বলেন, ইউনুছ আলীর দখল করা এই জায়গা ছিল নদীর মূল প্রবাহ। কিছু জমির নিচু অংশে ধান চাষ হতো। ইউনুছ আলী প্রভাব খাটিয়ে নদীর এ জায়গা দখল করে নিয়েছেন।

গত ২২ ডিসেম্বর দেখা যায়, ইউনুছ আলীর দখল করা জমিতে কৃষি খামার করা হয়েছে। সেখানে ফটকে লেখা, ‘ক্রয়সূত্রে এই সম্পত্তির মালিক জনাব আব্দুস সোবহান ফারুক, চেয়ারম্যান, সাফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। জমির পরিমাণ ৩৪ (চৌত্রিশ) একর।’ সাফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আব্দুস সোবহানও ব্যাংকের মাধ্যমে জমি ক্রয়ের দাবি করেন।

বেসিক ব্যাংকের রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুল কুদ্দুস সরকার বলেন, ইউনুছ আলীর আগ্রহে তাঁরা জমি বিক্রির জন্য ক্রেতার সঙ্গে বায়না করেছেন। কীভাবে নদের জমি বিক্রি করছেন, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এত কিছু জানি না।’

রাজারহাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি নূরে তাসনিম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, জমি কেনাবেচার বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গত দুই বছরে দখলদার উচ্ছেদের তাগিদ দিয়ে ছয়বার জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়। এখন নদের জমি বিক্রির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, চাকিরপশার নদের জমি বিক্রির বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। নদ-নদী জনগণের সম্পত্তি, যা কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয়।

বদ্ধ জলমহাল দেখিয়ে ইজারা

সম্প্রতি চাকিরপশার নদকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে আগামী ১৪৩০ সনের জন্য ইজারার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। ১৪২৮–১৪২৯ সনেও একদল অ–মৎস্যজীবীকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবির মুখে এই ইজারা বাতিল করা হয়। যদিও দখলদারদের বাধায় স্থানীয় মানুষ ও মৎস্যজীবীরা নদে নামতে পারেননি।

নদ সুরক্ষা কমিটির নেতাদের অভিযোগ, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট চাকিরপশারকে জলমহাল হিসেবে ইজারা না দিতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সায়রাত শাখা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদনেও বন্দোবস্ত না দেওয়ার কথা বলা হয়।

চাকিরপাশার নদ সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ অভিযোগ করে বলেন, জেলা প্রশাসন অবৈধ দখল উচ্ছেদে আন্তরিক নয়। বরং ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় এসএ রেকর্ডে নদের বেশ কিছু জমি দখলদারদের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। দখলদারদের নামে জমির নামজারিও হয়েছে। এখন নদের জমি হরদম বেচাকেনা চলছে, ইজারাও দেওয়া হচ্ছে। নদের মতো প্রবাহমান একটি জীবন্ত সত্তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সম্প্রতি কুড়িগ্রামে যোগ দিয়েছেন। চাকিরপশার নদ নিয়ে জটিলতার বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। ইজারা বন্ধের জন্য তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর দাবি, সব জটিলতা কাটিয়ে চাকিরপশার নদকে দখলমুক্ত করা হবে।