কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর পাড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৫৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৭টি ভবন
কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর পাড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৫৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৭টি ভবন

রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ফ্ল্যাট

  • ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী হতদরিদ্র ও ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও, এই নীতি ভেঙে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে।

  • অনেক বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রতিটি ফ্ল্যাট সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ।

  • অনেকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে নিজেরা না থেকে ভাড়া দিচ্ছেন।

  • সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত হওয়ায় খাবার ও গোসলের জন্য অনুপযোগী।

  • জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কাউন্সিলরের বক্তব্যের মধ্যে তালিকা প্রণয়ন নীতিমালার বিষয়ে ভিন্নতা দেখা গেছে।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকায় কক্সবাজার শহরের সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমানের নাম আছে। তিনি আওয়ামী লীগেরও নেতা। শহরে নিজের বাড়ি থাকার পরও ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন একই দলের নেত্রী টিপু সুলতানা। তালিকায় আরও আছেন স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলরের বোন ও তাঁর স্বামী।

কক্সবাজার শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী। এ নদীর পূর্ব-উত্তর পাড়ের খুরুশকুল এলাকায় গড়ে উঠছে ৪ হাজার ৪০৯ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুর জন্য আবাসন প্রকল্প। এখানে ২৫৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৭টি ভবন। ভবনগুলোর নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন নদী, গাছ ও ফুলের নামে। এখানে পয়োনিষ্কাশন ও রাস্তার নির্মাণকাজ এখনো চলছে।

২০১৭ সালে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নামে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে প্রথমবারের মতো নেওয়া জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আবাসন প্রকল্পে প্রকৃত উদ্বাস্তুদের অধিকাংশেরই ঠাঁই হয়নি। বরং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অনেকেই প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন।

ফ্ল্যাট বরাদ্দে নানা অনিয়মের বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরকে জানিয়েছি। এখন যে সিদ্ধান্ত আসে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন, জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার

স্থানীয় সমিতি পাড়ার বাসিন্দা ফারুকুন্নেছা অভিযোগ করেন, এক দশকের বেশি সময় এখানে আছেন। অথচ এখানে থাকেন না—এমন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

জলবায়ু উদ্বাস্তু পাড়ার অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তি মো. নুরুল্লাহ (৭৫) গত ১৮ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ থেকে ৪৫ বছর ধরে এখানে বাস করছি। বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে এখন উচ্ছেদ হতে হবে। কিন্তু তালিকায় আমার নাম নাই। কাউন্সিলরের কাছে গিয়েছি কয়েকবার। আশ্বাস দিলেও তালিকায় নাম তোলেননি। আমার ছয় ছেলের ছয়টি পরিবার। প্রথম তালিকায় তাঁদের নাম ছিল। হালনাগাদ করার সময় এলাকায় পাওয়া যায়নি বলে তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্ল্যাট বরাদ্দে নানা অনিয়মের বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরকে জানিয়েছি। এখন যে সিদ্ধান্ত আসে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’

কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করার সময় উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য মূলত আবাসন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। বসতিগুলো ছিল খুরুশকুলের পশ্চিম পাশে। এখানকার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরার টেক, মোস্তাকপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনার ডেইল, কুতুবদিয়াপাড়া, বাসিন্নাপাড়াসহ মোট ২১টি মহল্লা। এর সব কটিই সরকারের খাসজমি।

২০১৭ সালে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নামে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে কক্সবাজারের দ্বীপ অঞ্চল মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার বাস্তুচ্যুত লোকজন ১৯৮১ সাল থেকে এখানে আশ্রয় নিয়ে জনবসতি গড়ে তুলেছিলেন। বিমানবন্দরের জন্য তাঁদেরই উঠিয়ে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তারপর পুনর্বাসনের জন্য ২০১১ সালের দিকে ২১ মহল্লার ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারের একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এস আই এম আকতার কামাল, জেলা প্রশাসন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে এ তালিকা প্রণয়ন করেন। ২০১৬ সালে ওই তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এ সময় বাদ দেওয়া হয় এক হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তুকে।

নীতিমালা ভেঙে প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ

ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, তালিকায় কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ২১ মহল্লার হতদরিদ্র ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। অথচ অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ তালিকায় যেমন আছেন তৎকালীন সরকারি দলের লোকজন, তেমনি আছেন এখনকার বড় দলের প্রভাবশালীরাও।

ফ্ল্যাট পেয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামালের বোন মিনা বেগম ও তাঁর স্বামী খালেদ মোশাররফ। এই দম্পতি কুতুবদিয়ায় থাকেন, তাঁরা ২১ মহল্লার বাসিন্দা নন। ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন বিএনপির ১ নম্বর ওয়ার্ড পূর্ব শাখার সভাপতি আবুল বশর, পশ্চিম শাখার সভাপতি সাবেরের মেয়ে তানিয়া, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা নুর উদ্দিন, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আতিক উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজ উদ্দিন, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রোজিনা আক্তার, ওয়ার্ড যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের নেত্রী টিপু সুলতানা এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক মো. হানিফ। এ ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত খোরশেদ, আবু তাহের, সিরাজুল করিম ও জিল্লুল করিম।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমান, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক সরওয়ার আলম ও জেলা যুবদলের তৎকালীন আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক দিদারুল ইসলাম। এ ছাড়া তালিকায় স্বামী ও স্ত্রী দুজনের নামেই ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ ও তালিকায় উদ্বাস্তুদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে—জানতে চাইলে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প এলাকায় বসবাস করার একটা নীতিমালা আছে। কিন্তু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো নীতিমালা ছিল না। ২০১১ সালে সরেজমিনে যাঁদের পাওয়া গেছে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তালিকা আবার হালনাগাদ হয়। সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল ফ্ল্যাট বরাদ্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো নীতিমালা ছিল না বললেও জেলা প্রশাসন থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয় ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা আছে। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কারা হতদরিদ্র, কারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল—এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে যাঁরা ক্লাইমেট রিফিউজি, তাঁরা ৯৯ পারসেন্ট গরিব।’

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত আধুনিক ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে

তাহলে সাবেক পৌর মেয়র ও তৎকালীন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা, কাউন্সিলরের বোন, বোনের স্বামী তালিকায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই এলাকায় সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমানের দোকান ছিল, তাই তাঁর নাম এসেছে। তালিকা করার সময় যাঁরা সেখানে অবস্থান করেছিলেন, তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর তাঁর বোন ২১ মহল্লার বাসিন্দা হিসেবে ফ্ল্যাট পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

ক্ষমতাকে দুর্নীতির লাইসেন্স বানানো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য আছে। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আতিক উল্লাহও বলেছেন, তিনি ২১ মহল্লার বাসিন্দা। তাই এই ফ্ল্যাট তাঁর প্রাপ্য।

গত ১৯ এপ্রিল গেলে ২১ মহল্লার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমান সেখানে জায়গা দখল করে দোকান করেছিলেন। তালিকা হওয়ার আগে সেটা বিক্রিও করেছেন। এরপরও তালিকায় তাঁর নাম আছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমান পলাতক থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

টিপু সুলতানার কক্সবাজারে বাড়ি আছে, তাহলে তিনি কীভাবে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেলেন, জানতে চাইলে আকতার কামাল বলেন, ‘তালিকা যেভাবে হয়েছে, সেভাবে পেয়েছি। আর আমরা কাউকে অগ্রাধিকার দিই নাই। প্রশাসন ও সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে এ তালিকা করা হয়েছে। ওখানে কারও হাত নাই।’

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে টিপু সুলতানা ও তাঁর স্বামী মো. ইউসুফের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁদের দুজনের মুঠোফোনই বন্ধ পাওয়া গেছে। কক্সবাজারে ঝাউতলায় তাঁদের বাড়িতে গিয়েও তাঁদের দেখা পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় কাউন্সিলর ছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন কীভাবে উদ্বাস্তুদের শনাক্ত করেছে—জানতে চাইলে সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ‘ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে প্রশাসন শনাক্ত করেছে। আর ২০১১ সালে তালিকা হয়েছে। ওই সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না।’

তবে দায়িত্ব ছিলেন না বললেও ২০১১ সালে আকতার কামাল কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের পরিচালক মো. গোলাম মোর্তজা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন বা সিভিল এভিয়েশন নিজেরা এলাকায় গিয়ে তালিকা তো করতে পারবে না। স্থানীয় কাউন্সিলরের সহযোগিতায় তালিকা করা হয়েছে।

বাদ পড়েছে প্রকৃত উদ্বাস্তুরা

১৯৮৪ সালে সমিতি পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন মো. জাহাঙ্গীর (৫৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম তালিকায় তাঁর নাম ছিল। হালনাগাদের সময় এলাকায় পাওয়া যায়নি বলে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘উচ্ছেদ হলে আমার কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না। কাউন্সিলর কয়েকবার আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু সুরাহা হয়নি।’

কিসের ভিত্তিতে তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ২০১৬ সালের দিকে প্রশাসন থেকে তালিকা হালনাগাদ করার জন্য আসে। কারা আছে কারা নেই দেখেছে। এখানে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই।

খাসজমি ছেড়ে চলে যাওয়া অনেককে টাকার বিনিময়ে ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন—এমন অভিযোগের জবাবে আকতার কামাল বলেন, কোনো তালিকার ব্যাপারে তাঁর হাত ছিল না।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, ‘আমি আসার পর প্রকল্পে একটা যাচাই-বাছাই করেছিলাম। এখানে কিছু পরিবার থাকে। কিছু পরিবার জায়গা অন্যদের দিয়ে দিয়েছে। কিছু পরিবার বরাদ্দ নিয়েছে, কিন্তু থাকে না। এখন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সেটা বাস্তবায়ন করা হবে।’

কেউ ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন, কেউ দিয়েছেন ভাড়া

কক্সবাজার শহরের কস্তুরীঘাট সেতু পেরিয়ে একটু উত্তরে গেলে বাঁকখালী নদীর পাড়ে চোখে পড়বে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প। ‘মনখালী’ নামের একটি ভবনে উঠে দেখা গেল, পাঁচতলাবিশিষ্ট ভবনের প্রতিটি তলায় চারটি করে ফ্ল্যাট। ৬৫০ বর্গফুটের প্রতিটি ফ্ল্যাটে একটি কক্ষ, একটি ডাইনিং স্পেস, একটি বাথরুম, গোসলের জন্য আলাদা একটি রুম, একটি ব্যালকনি ও একটি রান্নাঘর আছে। এ ভবনের ৫০১ নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সাজেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ করেছিল এমন অনেকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। ‘সোপান’ নামে পাশের ভবনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেত্রী রোজিনা ইসলাম ফ্ল্যাট পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ওই ফ্ল্যাট তিনি ভাড়া দিয়েছেন।

এ বিষয়ে সোপান ভবনে ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

মনখালী ভবনের ২০টি ফ্ল্যাটের কয়েকটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কেউ বরাদ্দ নিয়েও থাকছেন না। কেউ আবার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব নিয়ে সাজেদা বেগম ছাড়া আর কেউ প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

সাজেদা বেগম বলেন, প্রতিটি ফ্ল্যাট সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভাড়া দিলে পাওয়া যায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল হয়ে গেলে এগুলোর দাম আরও বাড়বে।

মনখালী ভবনের চারতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া তাসলিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভাড়া নিয়েছি বছরখানেক হলো। মূল মালিককে ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিই।’ তবে তিনি মূল মালিকের নাম জানাতে চাননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ভবনের আরেকজন বাসিন্দা বলেন, এ ভবনের ২০৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি বিক্রি করা হয়েছে। মূল মালিক গফুরের কাছ থেকে সেটি কিনেছেন রুবেল দাশ নামের এক ব্যক্তি।

সোপান ভবনেও বেশ কয়েকজন ভাড়াটের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে মোছাম্মৎ ফতনি নামের একজন প্রথম আলোকে বলেন, বাহাদুর নামের একজন ফ্ল্যাটটি পেয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন তিনি।

মনখালী, সোপান, কোরাল, সোনালী, গন্ধরাজ, গুলমোহর—এ ছয়টি ভবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় মোট চারটি জোন। জোন-১ আবাসিক এলাকা, জোন-২ বাফার জোন, জোন-৩ পর্যটন এলাকা ও জোন-৪-এ আধুনিক শুঁটকিমহাল ও সেলস সেন্টার তৈরি করা হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষমতাকে দুর্নীতির লাইসেন্স বানানো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য আছে। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে।’

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটা সুযোগ হলো এই ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকা পুনর্বিবেচনা করা। বাস্তবিক অর্থে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা যেন এ প্রকল্পে পুনর্বাসিত হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব।’

খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে এখনো রাস্তা ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কাজ চলছে, যা প্রকল্পের সম্পূর্ণতা লাভের পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকল্পের অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা

প্রকল্পের ২৫৩ একর এলাকাকে চারটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। জোন-১-এ ১১১ একর জায়গাজুড়ে তৈরি হয়েছে আবাসিক এলাকা, যেখানে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৬০০ পরিবার বসবাস শুরু করেছে। জোন-২ দুই একরের বাফার জোন, আর জোন-৩-এ ৯৫ একর জায়গায় গড়ে উঠবে পর্যটনকেন্দ্র। জোন-৪-এ ৪৫ একর জায়গায় থাকবে আধুনিক শুঁটকিমহাল ও সেলস সেন্টার, যা স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বাঁকখালী নদীর ওপর প্রায় ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের খুরুশকুল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, যা প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য যাতায়াতকে সহজ করেছে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নির্মিত হয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনাও প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া বাসিন্দাদের ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাতে একটি ৩ হাজার ৫০০ মুসল্লি ধারণক্ষমতার মসজিদ, একটি মন্দির এবং একটি কবরস্থানও তৈরি করা হয়েছে।

বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রা, আছে চ্যালেঞ্জও

২০২০ সালে প্রথম পরিবারগুলো এখানে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান গড়ে উঠেছে, আর এখানকার নারীরা হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন। মুদিদোকানি আবদুল গফফার জানান, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার হয়, সবই মোটামুটি এখানে পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পটি ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ জনপদে রূপ নিচ্ছে।’

তবে এই সুন্দর চিত্রের পেছনে রয়েছে কিছু কঠিন বাস্তবতা। বাসিন্দাদের সবচেয়ে বড় ভোগান্তি সুপেয় পানি নিয়ে। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত হওয়ায় তা পান করা বা গোসলের জন্য অনুপযোগী। আয়েশা বেগম নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘খাবার পানি জোগাড় করতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। গোসল আর খাবার পানি অন্য এলাকা থেকে নিয়ে আসতে হয়, যা চারতলায় টেনে তুলতে অনেক কষ্ট হয়।’ বেবি আক্তার নামের আরেক বাসিন্দা সরকারের কাছে খাওয়ার পানির সুব্যবস্থা করার আবেদন জানিয়েছেন।

এ ছাড়া যাতায়াতব্যবস্থা একটি বড় সমস্যা। প্রকল্পের অভ্যন্তরে ২০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের কথা থাকলেও আবাসিক এলাকায় এখনো পাকা সড়কের দেখা মেলেনি। কাজের সন্ধানে বের হওয়া মানুষজনের একমাত্র ভরসা টমটম, যা সব সময় পাওয়া যায় না। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অভাবও একটি বড় চিন্তার কারণ। আবদুল গফফার বলেন, ‘অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক নেই। একটা ছোট কমিউনিটি ক্লিনিক হলে অনেক উপকার হতো।’

খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য একটি আশার আলো দেখালেও, সুপেয় পানি, যাতায়াত ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা না গেলে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন কঠিন হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ এ প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ সফলতা নিশ্চিত করতে পারে।