আইসিটির প্রকল্প: ৩৩০ কোটি টাকায় তৈরি গেম ও অ্যাপ কাজেই এল না

২০১৬ সালে ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়। কাজ দেওয়া হয় কাছের লোকদের।

মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রথমে আলাদা তিনটি কর্মসূচি নিলেও তা ব্যর্থ হয়। এরপর আবার ৩৩০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি বেশির ভাগ গেম ও অ্যাপ কোনো কাজে আসছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঘুরেফিরে নিজেদের লোকদের কাজ দিতে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পের মোট অর্থের ১৭ শতাংশের বেশি শেখ পরিবারের নামে সিনেমা ও গেম তৈরিতে ব্যয় হয়েছে।

২০১৬ সালের জুলাইয়ে ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়। তিন দফায় মেয়াদ বেড়ে এ প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩০ কোটি টাকা। চলতি ডিসেম্বরে শেষ হবে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পটির পিসিআর প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে। প্রকল্পে প্রশিক্ষণ বাবদ ১৩৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। অ্যাপ ও গেম তৈরিতে ব্যয় হয় ১৬৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮টি গেমিং ও অ্যাপস ল্যাব করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঘুরেফিরে নিজেদের লোকদের কাজ দিতে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পের মোট অর্থের ১৭ শতাংশের বেশি শেখ পরিবারের নামে সিনেমা ও গেম তৈরিতে ব্যয় হয়েছে।

কাছের লোকদের জন্য প্রকল্প

ডিজিকন টেকনোলজিসের সঙ্গে যৌথভাবে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনস লিমিটেড (এমসিসি) সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে। প্রকল্পে এই দুই কোম্পানি ৩০ কোটি ৪৪ লাখ টাকার কাজ পায়।

খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদের (পলক) ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এমসিসি অনেক কাজ পেয়েছে। এমসিসিকে পরে এনডিই ইনফ্রাটেক কিনে নেয়।

এমসিসির প্রধান নির্বাহী ও এনডিই ইনফ্রাটেকের পরিচালক মো. আশরাফ খান দাবি করেন, সম্পর্ক নয়, তিনি প্রতিযোগিতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ পেয়েছেন। ডিজিকন টেকনোলজিসের প্রধান ওয়াহেদ শরীফ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু বলে প্রচলিত রয়েছে। আইসিটি খাতে তাঁর একচেটিয়া প্রভাব ছিল। সরকার পতনের আগেই তিনি বিদেশে চলে গেলেও প্রতিষ্ঠান সচল রয়েছে।

ওয়াহেদ শরীফ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, নিয়ম মেনেই তাঁর প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে।

মোবাইল গেম প্রকল্পে বেশি কাজ পাওয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে প্রাইম টেক সল্যুশন, ইজি টেকনোলজি ও স্পিনঅফ স্টুডিও।

তথ্যপ্রযুক্তি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নাটোরের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাসরুল আলম (মিলন) আইসিটি বিভাগে কমিশন–বাণিজ্য করতেন। শেষ দিকে এসে তিনি নিজেই কোম্পানি খোলেন। অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি প্রাইমটেক, স্পিনঅফসহ অন্যদের সঙ্গে কাজ করতেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রাইমটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা রাশেদুল আলম বলেন, মাসরুল নিজের অভিজ্ঞতার জন্য তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রায় একই কথা বলেন স্পিনঅফের প্রতিষ্ঠাতা এ এস এম আসাদুজ্জামান। মাসরুলের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আবার পলকের ঘনিষ্ঠ মফিজুর রহমান ইজি টেকনোলজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আইসিটি বিভাগসহ পলকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনার একচেটিয়া কাজ করত ইজি টেকনোলজির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ঢাকা লাইভ। সরকার পতনের পর প্রতিষ্ঠানটি লাপাত্তা হয়ে গেছে।

বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, কাছের কিছু ব্যক্তির জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। এটা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছিল।

অ্যাপ ও গেমের অবস্থা

গুগল প্লে স্টোরে এ প্রকল্পের নামে ১৫০টি অ্যাপ পাওয়া যায়। বেশির ভাগ অ্যাপের ডাউনলোডের পরিমাণ ১টি, ১০টি, ৫০টি ও ১০০টি করে। সর্বোচ্চ ৫০ হাজার করে ডাউনলোড হয়েছে ডিজিটাল শিশু শিক্ষা ও মুজিব ১০০ অ্যাপ।

করোনা মহামারিকালে ২০২০ সালে এ প্রকল্পে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘লাইভ করোনা টেস্ট’ নামে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না।

শেখ পরিবারকে নিয়ে ৫০ কোটি ব্যয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বানানো বিভিন্ন অ্যাপ ও গেমের পেছনে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের সাড়ে ১৭ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ২৩টি উক্তি নিয়ে থ্রি–ডি হলোগ্রাম তৈরি হয়েছে এ প্রকল্পের টাকায়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ২১ কোটি টাকা।

প্রকল্পের প্রকিউরমেন্টের ৬৪টি কাজের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৯টি বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেলকে নিয়ে বানানো অ্যানিমেশন ও গেম তৈরি। এতে চ্যাটবট, অভিধান, অ্যাপ ও অ্যানিমেশন সিনেমা রয়েছে।

২০২২ সালে শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ নামে একটি গেমিং প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন করা হয়। সব মিলিয়ে এসব কাজে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়।

প্রকল্পে আট বছরে ১১ পরিচালক

মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে ১১ জন কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন এক থেকে দুই বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন। ৫ জন ১ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৯ মাস কাজ করেছেন। বাকি তিনজন এক মাসও কাজ করতে পারেননি। একজন ১৩ দিনও কাজ করেছেন।

আইসিটি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ প্রকল্পে প্রচুর তদবির ও সুপারিশ আসত। তাই কেউ থাকতে পারতেন না।

প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কাজ করা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে সরানোর জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ জনপ্রশাসনে ডিও লেটার দিয়েছিলেন।

এ প্রকল্প প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রকল্পের ধারণা ও উদ্দেশ্য ভালো ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নে সমস্যা ছিল। বাংলাদেশকে তুলে ধরে, বিশ্বমানের এমন অন্তত একটি গেম হলেও প্রকল্পটিকে সফল বলা যেত। কিন্তু তা হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পেছনে প্রকল্পের ব্যয় প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, যেসব মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি হয়েছে, তা এককালীন। এর থেকে পরবর্তী মানুষের পাওয়ার কিছু নেই। একটি প্রকল্পের ছয় ভাগের এক ভাগই যদি এসবের পেছনে ব্যয় হয়, তবে এর প্রয়োজনীয়তা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।