পুলিশ সপ্তাহে মতবিনিময় সভা

জনগণ প্রভাবমুক্ত পুলিশ চাইলেও, রাজনৈতিক নেতারা পেশাদার পুলিশ চাননি

পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ অডিটরিয়ামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তারা। ঢাকা, ১ মে
ছবি: সাজিদ হোসেন

জনগণ পেশাদার ও প্রভাবমুক্ত পুলিশ চাইলেও রাজনৈতিক নেতারা কখনো তা চাননি। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। জনগণের বিপক্ষে পুলিশকে দাঁড় করানো যাবে না। পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার।

পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ অডিটরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ: নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এমন মতামত তুলে ধরেন।

আইজিপি বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় মুখ্য আলোচক ছিলেন শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘পুলিশ যে একরকম অদ্ভুত অবস্থায় আছে...এর কারণ অনুসন্ধানের মতো উদার চিন্তা থাকা উচিত। পুলিশ দলীয় পুলিশ হয়ে যায়, সেটা তো বাহ্যিক। কিন্তু ভেতরে সমস্যা আছে।’

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও বিধিতে পদে পদে সমস্যা আছে। সর্বশেষ যে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, তারাও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্বের গোড়ায় যেতে হবে। জনগণের বিপক্ষে পুলিশকে দাঁড় করানো যাবে না।

মতবিনিময় সভায় সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা‌ বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পুলিশের কাজ স্বাধীনভাবে করার সুযোগ দিতে হবে। পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার—এমন সংস্কৃতি বদলাতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার।

মোহাম্মদ নুরুল হুদা আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজনীতিবিদেরা সবকিছুর পরিবর্তন করলেন, কিন্তু পেনাল কোড, সিআরপিসি, সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করলেন না। অথচ সেগুলোর পরিবর্তন যুগের দাবি ছিল। এর মানে হলো তখনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। তিনি বলেন, ‘এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমরা ১৯৭১ সালেও দেখিনি। আমাদের যে সংবিধান আছে, সেটি অপারেশনাল করতে হলে যেসব রুলস-রেগুলেশনগুলো পরিবর্তন করা দরকার, সেগুলো আমরা করলাম না। এর মানে আমাদের কথায় বৈপরীত্য রয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে যথাযথভাবে পেশাদার করতে চাননি।’ পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বিষয়ে সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, ‘এই কমিশন প্রতিবেদনে কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছে। নিরীক্ষার কথা বললেই ভয়ের বিষয়। যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষারই দরকার হয়, তাহলে এই কমিশনের দরকার ছিল কি?’

সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমরা সবাই স্বাধীন হতে চাই। কিন্তু স্বাধীনতা ভালো লাগে না। অনেকে গোলামি করতে চাই। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য গোলামি করতে চাই। এ দ্বিচারিতার অবসান হওয়া উচিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে দেয় না। তিনি বলেন, পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে।

পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন শিল্পপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলের অন্যায় আদেশ পালন থেকে বিরত থাকার জন্য পুলিশ সদস্যদের লড়াই করতে হবে।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস মনে করেন, পুলিশ যদি সত্যের পথে থাকে, তাহলে ‘নতুন বাংলাদেশে’ তাদের আস্থার জায়গা হবে। তিনি বলেন, পুলিশকে অসহায় মানুষের মাঝে দাঁড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়বে।

সভাপতির বক্তব্যে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ইতিবাচক হয়, যখন মানুষ দেখে এই বাহিনীটি কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, ‘জনতার পুলিশ’ মানে শুধু একটি পরিচয় নয়—এটি একটি দর্শন, যা নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে জনমনে আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান গড়ে তোলে।

আইজিপি বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, অস্ত্র নয়, জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রকৃত শক্তি। পুলিশ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকে, তবে তারা ভয়ের প্রতীক নয়, বরং হয়ে ওঠে ভরসার আশ্রয়স্থল।’

অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন মতবিনিময় সভাসংক্রান্ত উপকমিটির সভাপতি ও বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি (এসবি) গোলাম রসুল। তিনি বলেন, ‘আমরা জনতার মুখোমুখি থাকব না, পাশাপাশি থাকব। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই; জনগণের পুলিশ, সাধারণ মানুষের পুলিশ হতে চাই।’

মতবিনিময় সভায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শ্রমিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা, সব মহানগর পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা।