
ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সূত্র ধরে অর্থ আদায়ের মামলা ঘিরে সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত জয় পেয়েছেন হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। তাঁকে তিন মাসের মধ্যে ২০ লাখ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে যে রায় দেওয়া হয়েছিল তা বহাল রয়েছে। এ–সংক্রান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
রিভিউ আবেদনের শুনানি নিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ আজ বৃহস্পতিবার এ রায় দেন। তবে এরই মধ্যে আইনি লড়াইয়ে হরেন্দ্রনাথের চার দশকের বেশি সময় কেটে গেছে।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজ করে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর রায় দেন আপিল বিভাগ। রায়ে খরচা হিসেবে হরেন্দ্রনাথকে ২০ লাখ টাকা তিন মাসের মধ্যে দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চলতি বছর আপিল বিভাগে আবেদন করে। শুনানি নিয়ে এই আবেদন খারিজ করেছেন আপিল বিভাগ।
আদালতে হরেন্দ্রনাথের পক্ষে বিনা পারিশ্রমিকে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী ফাতেমা-তুজ জোহরা। সোনালী ব্যাংকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শামীম খালেদ আহমেদ এবং এম এ সোবহান।
রায়ের পর হরেন্দ্রনাথের আইনজীবী ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগ আগে মামলার সমুদয় ব্যয় হিসেবে খরচা বাবদ ২০ লাখ টাকা তিন মাসের মধ্যে হরেন্দ্রনাথকে দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রিভিউ খারিজ হওয়ায় এ রায় বহাল রইল। অর্থাৎ ওই দায় থেকে হরেন্দ্রনাথকে অব্যাহতিও বহাল রইল। এখন সোনালী ব্যাংককে ওই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।’
কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামে বাড়ি হলেও মেয়ে ও জামাতার সঙ্গে এখন ঢাকায় থাকেন হরেন্দ্রনাথ। আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন তাঁর বয়স ৮০ বছর। মামলা চালাতে তাঁর ৪০ বছর গিয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চালাতে গিয়ে সবকিছু হারিয়েছি। রায় পেয়ে আমি খুব খুশি।’ মামলায় ৯ জন বিবাদীর মধ্যে শুধু তিনি বেঁচে আছেন উল্লেখ করেন হরেন্দ্রনাথ।
হরেন্দ্রনাথের ভাষ্য, স্নাতক পাস করে ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংকের ঢাকার একটি শাখায় ১৯৮০ সালের দিকে যোগদান করেন তিনি। পরে তিনি যাত্রাবাড়ী শাখায় কর্মরত অবস্থায় রেমিট্যান্সসংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা শাখা থেকে লোকাল অফিসে পাঠানো হয়। তবে কিছুদিন পর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তহবিল তছরুপের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ১৯৮৬ সালের মার্চে তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই ঘটনা সূত্রে ‘পকেট ব্যাংকিংয়ের’ অভিযোগে সামরিক আদালতে হরেন্দ্রনাথের সাজা হয়। সাজা ভোগ শেষে ১৯৯০ সালে তিনি কারামুক্তি পান। এর আগে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
আইনজীবীর তথ্য অনুসারে, পরবর্তী সময়ে অর্থ আদায়ে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৯৮৮ সালে নিম্ন আদালতে মামলা (মানিস্যুট) করে। এ মামলায় একতরফা রায়ে ৯ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে আদেশ দেন অর্থঋণ আদালত। এর বিরুদ্ধে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আবেদন (বিবিধ মামলা) করেন হরেন্দ্রনাথসহ দুজন। ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত আবেদন গ্রহণ করে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট আপিল খারিজ করে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০২৩ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। শুনানি নিয়ে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর লিভ টু আপিল খারিজ করে রায় দেন আপিল বিভাগ। এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবেদন করে চলতি বছর। শুনানি নিয়ে রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় দেন আপিল বিভাগ।
রায়ের পর হরেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, হরেন্দ্রনাথকে যে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে অর্থাৎ চাকরিকালীন সুবিধাগুলো নিয়ে উচ্চ আদালতে তাঁর মামলা বিচারাধীন রয়েছে।