
গত দুই দশকে বাংলাদেশে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। আর জলবায়ু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আছে এ দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও প্রকৃতি। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় গণমাধ্যমকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। মানুষকে কেন্দ্রে রেখে সব ধরনের পরিকল্পনা করতে হবে।
আজ শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তন: প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ওই বৈঠকে দেশের শীর্ষ জলবায়ুবিশেষজ্ঞ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা বক্তব্য দেন। তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আরও বেশি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার ব্যাপারে প্রথম আলোর প্রতি আহ্বান জানান।
বৈঠকের শুরুতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আখতার বলেন, জলবায়ু নিয়মিত পরিবর্তনশীল। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের নানা তৎপরতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বাড়ছে। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি বদ্বীপ, সমুদ্রের খুব কাছে ও নিচু এলাকায় অবস্থিত। এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে।
হুমায়ূন আখতার সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এ ধরনের বড় প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেও আমলে নিতে হবে। আর সব ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে সমাজ ও স্থানীয় লোকজনকে বাদ দিয়ে কোনো কাজ করা উচিত নয়।
আমরা ঢাকায় যে দামে পানি খাই, উপকূলীয় এলাকার মানুষ তার চেয়ে ৪০ গুণ বেশি দামে পানি খায়।হাসিন জাহান, আবাসিক পরিচালক, ওয়াটারএইড, বাংলাদেশ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং ও জিআইএসের পরিচালক অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘৩০-৪০ বছর ধরে আমরা উপকূলের মানুষদের দুর্যোগের মাধ্যমে থাকতে দেখছি। প্রকল্পের পর প্রকল্প চলছে। চট্টগ্রামেও জলাবদ্ধতা দূর করতে হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও সমস্যা দূর হচ্ছে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়, তা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকতে পারে। এ জন্য সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে।’
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের আবাসিক পরিচালক হাসিন জাহান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের পরিমাণ এবং প্রবণতা বাড়ছে। আমাদের আগের চেয়ে অনেক উন্নত আশ্রয়কেন্দ্র করছে। নারীরা কি সেখানে যায়? তাঁদের প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়?’ তিনি বলেন, ‘নারীরা পরিবারে পুরুষদের চেয়ে কম পানি ও খাবার খান। বিশেষ করে পানি আনার কাজটি তাঁকে করতে হয়। অসুস্থ হলে তাঁরা চিকিৎসকের সহায়তা কম পান। আমরা ঢাকায় যে দামে পানি খাই, উপকূলীয় এলাকায় মানুষ তার চেয়ে ৪০ গুণ বেশি দামে পানি খায়।’ তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মতামতকে সামনে আনার পরামর্শ দেন।
গত দুই দশকে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত করেছে। বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু বিপন্ন দেশ হিসেবে তাই বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগোতে হবে।আশরাফুল হক, পরিবেশবিশেষজ্ঞ, ইউএসএআইডি
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগরে একটি পরিবারকে পেয়েছেন, যেখানে একটি ছেলেকে বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, সেখানকার নারীদের দুই-তিন কিলোমিটার দূরে পানি আনতে যেতে হয়। সেখানকার ৬০ শতাংশ শিশু ও তরুণের ২৫ বছর বয়সের আগেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা শুরু হচ্ছে।
উপকূলে লবণাক্ত এলাকায় উষ্ণতা বেশি বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ মো. কামরুজ্জামান। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে দেশে গমের উৎপাদন আর হবে না ও ধানের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে ৮ থেকে ১০ লাখ হেক্টর জমি পড়ে থাকে। উপকূলের ৫২ শতাংশ জমি কোনো না কোনোভাবে লবণাক্ততার শিকার। এসব বিষয়কেও আমাদের তুলে আনতে হবে।’
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আতিক আহসান বলেন, উপকূলীয় যেসব নদীতে আগে মিষ্টি পানি ছিল, সেখানে লবণাক্ত পানি চলে আসছে। এমনকি স্থানীয় পুকুরগুলো ছিল মিষ্টি পানির আধার। সেগুলো এখন লবণাক্ত হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে সমস্যা বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির পরিবেশবিশেষজ্ঞ আশরাফুল হক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর তাত্ত্বিক বিষয় নেই। এটা আমাদের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। গত দুই দশকে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত করেছে। বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু বিপন্ন দেশ হিসেবে তাই বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগোতে হবে।’
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ (প্রকৃতি, পরিবেশ ও জ্বালানি) আরিফ এম ফয়সাল বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু খাতে বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে। তবে জলবায়ু নিয়ে সবার আগে মানুষকে বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সুরক্ষার বিষয়টিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আনতে হবে।
দুর্যোগবিশেষজ্ঞ ও লেখক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমরা কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছি, তা–ও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের এখানে বছরে সাত মাস বৃষ্টি হয়। ভারতের রাজস্থানে বছরে সাত দিন বৃষ্টি হয়। তবে তারা ওই পানি ধরে রাখে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ডায়রিয়া ও কলেরা বাড়ছে। ফলে আমাদের এসব সমস্যার সমাধানের বিষয়টিকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আশির দশক থেকে আমরা শুনছি। এখন দেখি তা আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল এমনিতেই অবহেলিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সেখানে সবচেয়ে বেশি পড়ছে। তাই সেখানকার সংকট ও সমস্যাগুলো আমরা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরতে চাই।’
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা এবং গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে মতামত দেন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরির ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে জোর দেন।
প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এমআরডিআই) নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান ও প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক রাজীব হাসান।