পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায়ে পৃথক তিন মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদকে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা পৃথক ওই তিন মামলার প্রতিটিতে শেখ হাসিনা আসামি। প্রতিটি মামলায় তাঁকে ৭ বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রতিটি মামলায় তাঁকে এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদকে পৃথক মামলায় পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর পাশাপাশি দুজনকেই এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল বৃহস্পতিবার এই রায় (পৃথক তিন মামলার) ঘোষণা করেন।
এর আগে ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক রায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ওই রায় ঘোষণার পর দুর্নীতির মামলায় এবার ঢাকার একটি আদালত সাজা দিলেন শেখ হাসিনাকে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা প্লট দুর্নীতির মামলার রায় পড়ার সময় বিচারক বলেন, ‘শেখ হাসিনা নিজে প্লট নেওয়ার পর তাঁর ছেলে ও মেয়ের নামেও বরাদ্দ নেন। এরপর তাঁর বোন শেখ রেহানা, বোনের মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের নামেও বরাদ্দ নিয়েছেন। জনগণের সম্পত্তির প্রতি ওনার (শেখ হাসিনার) লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছে। উনি চারবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপরও জনগণের সম্পদ থেকে লোভ সামলাতে পারেননি।’
রায়ে শাস্তি ঘোষণার আগে বিচারক মামলার পটভূমি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্লট দুর্নীতির বিষয়টি সাংবাদিকদের মাধ্যমেই উঠে আসে। মিডিয়া যে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে, আমরা এ মামলার মাধ্যমে দেখলাম। আপনাদের (সাংবাদিকদের) রিপোর্ট না থাকলে দুদক কখনোই এ মামলা করত না। পত্রিকার রিপোর্টের আলোকেই দুদক পদক্ষেপ নিয়েছে।’
এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ১২ জন। আসামিদের মধ্যে শুধু একজনকে (গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার) খালাস দিয়েছেন আদালত। অন্য আসামিদের এক বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সাজা পাওয়া আসামিরা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রীও রয়েছেন। সাজাপ্রাপ্তরা হলেন পূরবী গোলদার (১ বছরের কারাদণ্ড), আনিছুর রহমান মিঞা (৫ বছর), মোহাম্মদ খুরশীদ আলম (১ বছর), শফিউল হক (৩ বছর), মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (৩ বছর), সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (৩ বছর), নায়েব আলী শরিফ (১ বছর), কাজী ওয়াছি উদ্দিন (৬ বছর), মো. শহীদ উল্লা খন্দকার (৬ বছর) ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ (৬ বছর)।
গত ১৪ জানুয়ারি মামলাটি করে দুদক। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলের নতুন শহরে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। তাঁর ঢাকা শহরে বাড়ি থাকার পরও হলফনামায় তথ্য গোপন করেন। এ কারণে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।
এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় গত ১১ আগস্ট। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় ১৭ নভেম্বর। এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৯ জন।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল আদালতের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি বিজিবিও আদালত এলাকায় মোতায়েন ছিল। বিচারক এজলাসে আসেন বেলা ১১টা ২৩ মিনিটে। তিনি সবার উদ্দেশে সালাম জানিয়ে নিজ চেয়ারে বসেন। এরপরই রায় পড়া শুরু করেন।
রায় ঘোষণার সময় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫–এর বিচারক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘যদি কেউ আবেদন না করে, তাহলে সে প্লট পাবেই না। কিন্তু আমরা দেখেছি, এ প্লটের কার্যক্রম শুরু হয়েছে কোনো ধরনের আবেদন ছাড়াই।’
বিচারক বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) উল্লেখ করেছেন, “আমার নামে ঢাকা শহরে কোনো প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।” এটা একটা প্রতারণা। ওনার (শেখ হাসিনা) হলফনামাটি কেউ গ্রহণ করবে কি না, আমার জানা নেই। কারণ, আইন অনুযায়ী নোটারিটি সত্যায়িত হয়নি। সেখানে কারও কোনো স্বাক্ষর নেই। এখানে নিয়ম মানা হয়নি। এগুলো উপেক্ষা করে হলফনামাকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করে রাজউক ৩ আগস্ট (২০২২ সাল) শেখ হাসিনাকে প্লট বরাদ্দ দেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি প্লট বুঝে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন।’
প্লট বুঝে নেওয়ার আবেদনের প্রসঙ্গে বিচারক বলেন, ‘আমরা বুঝেছি, ওনার সম্পদের প্রতি লোভ আছে। ভালোবাসা আছে। ওনাকে যখন বরাদ্দ দেওয়া হয়, উনি তখন সেটা ছুড়ে ফেলতে পারতেন। বলতে পারতেন, আমি তো আবেদন করিনি।’
প্লট দুর্নীতির অভিযোগে গত ১৪ জানুয়ারি সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলার মোট আসামি ১৭ জন। এ মামলায়ও আসামিদের মধ্যে শুধু একজনকে (সাইফুল ইসলাম সরকার) খালাস দিয়েছেন আদালত। অন্য আসামিদের এক থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সাজা পাওয়া ব্যক্তিরা রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা। এ মামলায়ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে সাজা দেওয়া হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঢাকা শহরে বাড়ি/ফ্ল্যাট বা আবাসনসুবিধা থাকার পরও তিনি বিষয়টি গোপন করেছেন। এ কারণে প্লট বরাদ্দে আইন, বিধি, নীতিমালা ও আইনানুগ পদ্ধতি লঙ্ঘিত হয়েছে। তাঁর মা শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করেছেন। মামলার আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লটটি সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন।
এই মামলার রায়ে যাঁদের সাজা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন শেখ হাসিনা (৭ বছরের কারাদণ্ড), সজীব ওয়াজেদ জয় (৫ বছর), পূরবী গোলদার (১ বছর), কাজী ওয়াছি উদ্দিন (৬ বছর), মো. শহীদ উল্লা খন্দকার (৬ বছর), আনিছুর রহমান মিঞা (৫ বছর), মোহাম্মদ খুরশীদ আলম (১ বছর), তন্ময় দাস (৩ বছর), মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (৩ বছর), সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (৩ বছর), মাজহারুল ইসলাম (১ বছর), নায়েব আলী শরিফ (১ বছর), কামরুল ইসলাম (৩ বছর), মো. নুরুল ইসলাম (৩ বছর), মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন (৬ বছর) ও শরীফ আহমেদ (৬ বছর)।
গত ৩১ জুলাই এই মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় ১১ আগস্ট। মামলায় ২৩ জন সাক্ষ্য দেন।
প্লট দুর্নীতি মামলায় গত ১২ জানুয়ারি সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক। এ মামলায় মোট আসামি ১৮ জন। এ মামলায়ও আসামিদের মধ্যে শুধু একজনকে (সাইফুল ইসলাম সরকার) খালাস দিয়েছেন আদালত। অন্য আসামিদের এক থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাজা পাওয়া ব্যক্তিরা রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে এ মামলায়ও সাজা দেওয়া হয়েছে।
সাজা পাওয়া আসামিরা হলেন সায়মা ওয়াজেদ (৫ বছর কারাদণ্ড), শেখ হাসিনা (৭ বছর), পূরবী গোলদার (১ বছর), কাজী ওয়াছি উদ্দিন (৬ বছর), শহীদ উল্লা খন্দকার (৬ বছর), আনিছুর রহমান মিঞা (৫ বছর), মোহাম্মদ খুরশীদ আলম (১ বছর), কবির আল আসাদ (৩ বছর), তন্ময় দাস (৩ বছর), মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (৩ বছর), সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (৬ বছর), মো. হাফিজুর রহমান (১ বছর), হাবিবুর রহমান (১ বছর), শেখ শাহিনুল ইসলাম (৩ বছর) ও মো. নুরুল ইসলাম (৩ বছর), সালাহ উদ্দিন (৬ বছর) ও শরীফ আহমেদ (৬ বছর)।
এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় গত ১১ আগস্ট। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় ১৭ নভেম্বর। এ মামলায় ২৮ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তিন মামলায় আসামির তালিকায় নাম আছে ৪৭ জনের। এর মধ্যে শেখ হাসিনাসহ নয়জনকে তিন মামলাতেই আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তার আছেন একজন (মোহাম্মদ খুরশীদ আলম)। অন্যরা পলাতক।
এ মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুদকের আইনজীবীরা। রায় ঘোষণার পর দুদকের আইনজীবী খান মো. মঈনুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছি, আমরা সেটা পাইনি। দুদকের সঙ্গে আলোচনা করে এ মামলার আপিলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রাজউক সরকারি ভূমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ বিধান ও প্রক্রিয়া ক্রমাগত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেছে। চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জ্ঞাতসারে বাধ্যতামূলক শর্তাদি উপেক্ষা করেছেন, প্রক্রিয়াগত সুরক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং আবেদনগুলো এমন কৌশলে প্রক্রিয়া করেছেন, যা বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের অনুকূলে যায়। এই ভূমিকা এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার প্রদর্শন করে, যেখানে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য বিধিবদ্ধ আইনকে অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে গণ্য করা যায়।
আদালত বলেছেন, বরাদ্দগুলো (প্লট) ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা, আমলা এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষে হয়েছে। বাধ্যতামূলক আইনি বিধানকে এভাবে অবহেলা সংবিধানকে খাটো করে, আইনানুগ শাসনব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে এবং জনসাধারণের সম্পদকে ব্যক্তিগত সুবিধা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার উপকরণে রূপান্তর করে। যদিও আইনটি কিছু ‘স্পেশাল ক্যাটাগরিকে’ স্বীকৃতি দেয়, রাজউক কর্মকর্তারা যথাযথ নথিপত্র, যাচাই-বাছাই বা যোগ্যতার মানদণ্ড অনুসরণ না করে আবেদনপত্র অনুমোদনের মাধ্যমে বারবার কার্যপদ্ধতি লঙ্ঘন করেছেন। এ ধরনের কার্যক্রম পদের চরম অপব্যবহার এবং একটি বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক আস্থার প্রতি গভীর বিশ্বাসঘাতকতা।