ইট-পাথরের এই কংক্রিটের শহরে কখনো কখনো দম বন্ধ হয়ে আসে। একচিলতে সবুজের খোঁজ আমাদের মনকে শান্তি এনে দেয়। দিনের অনেকটা সময় আমরা কোনো না কোনো ছাদের নিচে কাটাই। নিজের বাড়ি, কর্মস্থল কিংবা ছুটির দিনে কোনো অবকাশকেন্দ্রে। এই ছাদ আর নিচের ঘরটা প্রাণহীন আর নির্জীব হলে জীবনে প্রাণ কমে যাবে। আধুনিক স্থাপত্যশিল্পে এখন নতুন এক দর্শন যুক্ত হয়েছে, সবুজ স্থাপত্য বা গ্রিন বিল্ডিং কনসেপ্ট। এটি কেবল নান্দনিকতার বিষয় নয়। সুস্থ, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও টেকসই জীবনের এক প্রতিচ্ছবি আসে আবাসনে সবুজের প্রাণবন্ত উপস্থিতি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন প্রকৃতির কোলে বসে কবিতা লিখতেন, তেমনি এখনকার স্থপতিরাও প্রকৃতির ছোঁয়া দিয়ে নির্মাণ করছেন ভবনে সবুজের কাব্য। ভবনের প্রতিটি তলা, প্রতিটি বারান্দা, প্রতিটি দেয়াল হয়ে উঠেছে যেন সবুজের ক্যানভাস। আমাদের সব মিলিয়ে গ্রিন এরিয়া ৩ লাখ ৪৮ হাজার ২১৬ বর্গফুট। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সবুজ আবাসনকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা মিরান্ডা, মেরিসা, কামাল্স রেসিডেন্স, তরুনীড়, এফ এস হাইট্স, ডায়ান্স ভিল, রিফ্লেকশন টি-১ ইত্যাদি বেশ কিছু প্রকল্প তৈরি করেছি। এ ছাড়া চট্টগ্রামে হোয়াইট ওক-মেহেদিবাগ, পার্ক উইন্ডসর–পাঁচলাইশ, খান প্লাজা–আগ্রাবাদ কমার্শিয়াল এরিয়া, সিকে টাওয়ার–হালিশহর নামে বিভিন্ন প্রকল্পে সবুজকে গুরুত্ব দিয়েছি আমরা।
একসময় ছাদ ছিল কেবল পানির ট্যাংক রাখার একটি কাঠামো। এখনকার আধুনিক ভবনের ছাদ যেন একটুকরা উঠান। সেখানে শোভা পায় দেশীয় গাছের সারি, ফুলের সমাহার আর শাকসবজির ছোট ছোট বাগান। ছাদবাগান এখন কেবল শখের বিষয় নয়, এটি পরিবেশের তাপমাত্রা কমাতেও সাহায্য করে। ইট-পাথরের তাপ শোষণ করে নেওয়া ছাদ এখন সবুজ গাছপালায় ভরে ওঠে। ছাদের গাছ কিংবা দেয়ালজুড়ে সবুজ বেষ্টনী ঘরের ভেতরকে রাখে শীতল। এতে বাইরের তপ্ত দুপুরের চেয়ে ৩-৪ ডিগ্রি কম তাপমাত্রা অনুভূত হয় ঘরের মধ্যে।
ভবন নির্মাণের সময় যে ধাতব বা প্লাস্টিকের বেষ্টনী ব্যবহার করা হয়। আধুনিক সবুজ দালানে তার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে জীবন্ত গুল্মের বেষ্টনী। এটি কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়; বরং পরিবেশের জন্যও উপকারী। এটি বায়ুদূষণ রোধে সাহায্য করে আর পাখির আবাসস্থল হিসেবেও কাজ করে। দেয়ালের সৌন্দর্যবর্ধনেও এখন গাছের ব্যবহার বাড়ছে। ভার্টিক্যাল গার্ডেন বা উল্লম্ব বাগান এখন বেশ জনপ্রিয়। ভবনের বাইরের দেয়ালজুড়ে ছোট ছোট টবে লাগানো হয় নানা ধরনের গাছ, যা পুরো ভবনকে এক অনন্য সবুজ আভা দেয়। এটি দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ঘরের তাপমাত্রাও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য আলো-বাতাসের অবাধ প্রবেশ অত্যন্ত জরুরি। সবুজ স্থাপত্যের মূলমন্ত্র হলো প্রাকৃতিক আলো আর বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার। ভবনের নকশা এমনভাবে করা হয় যেন দিনের বেশির ভাগ সময় কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন না হয়। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় যেন ঘরের ভেতর বাতাস চলাচল করতে পারে। এতে বিদ্যুতের খরচ যেমন কমে, তেমনি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশও তৈরি হয়। কেবল ভবন নির্মাণ করেই সবুজ স্থাপত্যের কাজ শেষ হয় না। এর আসল সফলতা নির্ভর করে এর বাসিন্দাদের ওপর। তাই স্থপতি ও নির্মাতা হিসেবে আমরা ফ্ল্যাট ও ভবনে বসবাসকারীদের সবুজ জীবনযাপনের জন্য উৎসাহিত করছি। বিভিন্ন ধরনের গাছের যত্ন নেওয়া, জৈব সার ব্যবহার করা ও পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রার বিষয়ে সচেতন করছি। ছোট পরিসরে হলেও নিজ হাতে একটি গাছ লাগানো, তার যত্ন নেওয়া, তাকে বড় হতে দেখা, এমন অভিজ্ঞতা এই শহরের মানুষের জন্য এক অন্য রকম আনন্দ। আমরা মানুষকে প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল করে তুলতে চাই।
মাশিদ রহমান: ডিভিশনাল ডিরেক্টর, র্যানকন হোল্ডিংস লিমিটেড ও এমডি, র্যাংগ্স প্রপার্টিজ লিমিটেড