‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় গত মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি
‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় গত মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি

ক্যানসার-চিকিৎসাবিষয়ক অনলাইন আলোচনা

প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে জরায়ুমুখের ক্যানসার নিরাময়যোগ্য

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ক্যানসার অভজারভেটরি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশের জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার নারী। দেশে নারীদের যত ধরনের ক্যানসার হয়ে থাকে, সেগুলোর মধ্যে এর অবস্থান দ্বিতীয়। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী এ ক্যানসারের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে জানুয়ারি মাসকে জরায়ুমুখের ক্যানসার–সম্পর্কিত সচেতনতার মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’ এ রকম তথ্য দিয়ে উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন শুরু করেন এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার–চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা।

এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আসমা সিদ্দিকা। বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, ডায়াগনসিস এবং রোগ নির্ণয়ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন তিনি। গত মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের হার নিয়ে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘হাসপাতালভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর আট হাজার নারী এ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যার মধ্যে পাঁচ হাজার মারা যায়।’ এর ঝুঁকি কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। টিকা ও স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এর থেকে মুক্তি পেতে পারি।’

জরায়ুমুখের ক্যানসারের উপসর্গ সম্পর্কে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘কিছু কিছু রোগীর লক্ষণ থাকে না, অনেকেরই থাকে। উপসর্গগুলো হলো, দুই মাসিকের মধ্যে অস্বাভাবিক রক্তপাত, যৌনমিলনের সময় বা পরে রক্তপাত, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা ইত্যাদি। অনেক সময় রোগী গলার পাশে একটা টিউমার নিয়েও এসেছে আমাদের কাছে। সুতরাং জরায়ুমুখের ক্যানসারের উপসর্গ নির্ভর করবে এটির পর্যায়ের ওপর।’

জরায়ুমুখের ক্যানসার কি ছোঁয়াচে? এটি ধরা পড়া মানেই কি মৃত্যু? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘কোনো ক্যানসার ধরা পড়া মানেই মৃত্যু নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এটির নিরাময় সম্ভব। তবে ক্যানসারের শেষ পর্যায়ে গেলে এটার মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। আর দর্শকদের আশ্বস্ত করতে চাই, শুধু জরায়ুমুখ না, কোনো ক্যানসারই ছোঁয়াচে না।’

কোন পর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে? এ ব্যাপারে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘লক্ষণ দেখা গেলে সময়ক্ষেপণ না করেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগী টেস্টের মাধ্যমেই বুঝতে পারবেন ক্যানসার আছে কি না। তবে উপসর্গ থাকলেই যে ক্যানসার হবে—এমন কথা নেই।’

আলোচনার এ পর্যায়ে জরায়ুমুখের ক্যানসারের স্ক্রিনিং পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেন ডা. আসমা সিদ্দিকা। তিনি বলেন, ‘স্ক্রিনিং মানে হলো, রোগের লক্ষণ হওয়ার আগে থেকেই সতর্কতামূলক পরীক্ষা করানো। জরায়ুমুখের ক্যানসার হয় “হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)”র কারণে, যা শরীরে ঢোকা থেকে শুরু করে ক্যানসারে পরিণত হতে ১০ থেকে ১৮ বছর সময় লাগে। সুতরাং ক্যানসার সংক্রমণ হওয়ার আগেই স্ক্রিনিংটা জরুরি। প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে “ভায়া টেস্ট”, যেটা যেকোনো স্বাস্থ্যকর্মী করতে পারে। বাকিগুলো হলো “প্যাপস” এবং “ডিএনএ” টেস্ট।’

স্ক্রিনিং এবং ডায়াগনসিসের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘ক্যানসার হয় গড়ে ৪৭ বছর বয়সীদের। সাধারণত আমরা ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষদের স্ক্রিনিং করতে বলে থাকি। কিন্তু যিনি উপসর্গ নিয়ে এসেছেন তিনি হলেন রোগী। তাই তাঁর রোগটাকে খুঁজে বের করার পদ্ধতিকেই ডায়াগনসিস বলে। কাজেই স্ক্রিনিং হয় সুস্থ মানুষের আর ডায়াগনসিস হয় রোগীর। মূলত এটাই এ দুয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য।’

বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘দেশেই এ ধরনের ক্যানসারের বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। যদি ধারাবাহিকভাবে বলি, প্রথমে টিস্যু ডায়াগনসিসের মাধ্যমে “হিস্টোপ্যাথলজি” করি। তারপর সিটিস্ক্যান, আলট্রাসনোগ্রাম, পেট সিটিস্ক্যান এবং এমআরআইয়ের মাধ্যমে ক্যানসারের পর্যায় নির্ধারণ করি।’ প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক যুক্ত করেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি এবং অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট হলো “এসকেএফ অনকোলজি”, যা ক্যানসার চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে।’

বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, ডায়াগনসিস এবং রোগ নির্ণয়ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. আসমা সিদ্দিকা

জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রকারভেদ সম্পর্কে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘এটি সাধারণত দুই ধরনের হয়—স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা এবং অ্যাডেনোকার্সিনোমা। তবে বেশির ভাগই স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা হয়ে থাকে।’ এটির সঙ্গে কি বংশগত কোনো সম্পর্ক আছে? এর উত্তরে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘এটার সঙ্গে বংশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা সম্পূর্ণ পরিবেশগত একটি ক্যানসার। অধিকাংশ নারীর শরীরেই এইচপিভি ভাইরাস থাকে কিন্তু শরীরের ইমিউনিটি দুই–তিন বছরের মধ্যে এটাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তাই কারও “এইচপিভি পজেটিভ” হলেই দুশ্চিন্তার কারণ নেই।’

এ ধরনের ক্যানসার নিরাময়ে এইচপিভি ভ্যাকসিনের ভূমিকা প্রসঙ্গে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘২০০৬ সাল থেকে এ ভ্যাকসিন আমেরিকায় দেওয়া শুরু হয়, যা ২০০৮ সালে ট্রায়াল দেওয়া হয়। এটি বর্তমানে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে দেওয়া হয়। ভ্যাকসিনটি ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সী অবিবাহিত মেয়েদের দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এটি ছেলেদেরও দেওয়া হয়। সুতরাং যদি উল্লিখিত বয়সের মেয়েদের ভ্যাকসিন দেওয়াটা নিশ্চিত করা যায়, আমরা জরায়ুমুখসহ অনেক ক্যানসার থেকে মুক্ত থাকতে পারব।’

কোন পদ্ধতিতে বর্তমানে জরায়ুমুখের ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘এ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে প্রথম চিকিৎসা হলো সার্জারি। এতে কাজ না হলে কেমো এবং রেডিওথেরাপি একসঙ্গে দেওয়া হয়। এটা শেষ হওয়ার পর ব্র্যাকি বা বিকিরণ–থেরাপি দিয়ে থাকি। এ ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে রোগী সুস্থ হতে পারে।’

বাংলাদেশে ও বিদেশের চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘কোনো পার্থক্য নেই। ক্যানসারের চিকিৎসা একজনের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কেউ রেডিওথেরাপি দেবে, কেউ কেমোথেরাপি দেবে—এটাকে বলে মাল্টি মডালিটি অ্যাপ্রোচ। তাই এ ধরনের ক্যানসারে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করার প্রয়োজন নেই।’

জরায়ুমুখের ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘এখনো এ ধরনের ক্যানসারে আগে থেকেই নারীরা চিকিৎসকের কাছে আসে না। যদিও ক্রমশ নারীরা সচেতন হচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে আরও সচেতনতা বাড়ানোসহ শিক্ষা এবং নারীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে উন্নত করতে হবে।’