‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়
‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়

অনলাইন আলোচনা

ক্যানসার জীবনের ‘শেষ’ নয়, দরকার মানসিক দৃঢ়তা

‘অনেকেই ভাবেন, ক্যানসারের চিকিৎসা মানেই ভয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আধুনিক চিকিৎসায় এখন এ চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম এবং রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরিবার ও সমাজের সহায়তা পেলে রোগীরা দ্রুত সেরে ওঠেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মানসিক দৃঢ়তা।’

এ কথা বলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. এ টি এম কামরুল হাসান।

স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস অক্টোবর। এ উপলক্ষে শনিবার (১১ অক্টোবর) এসকেএফ অনকোলজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন ডা. এ টি এম কামরুল হাসান। তিনি বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস ও চিকিৎসাসুবিধা বিষয়ে কথা বলেন। পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

শুরুতেই উপস্থাপক জানান, বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যানসার সবচেয়ে সাধারণ ক্যানসারের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি কম গুরুতর নয়। প্রতিবছর দেশে ১৩ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে ৭ হাজারের বেশি নারী প্রাণ হারান। তবে আশার খবর হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত করা গেলে স্তন ক্যানসারে বেঁচে থাকার হার প্রায় ৯৯ শতাংশ।

উপস্থাপক জানতে চান, স্তন ক্যানসার কেন নারীদের জন্য এত বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে? উত্তরে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, বিশ্বব্যাপী তো বটেই, বাংলাদেশেও স্তন ক্যানসারের হার বাড়ছে। এর মূল কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, দেরিতে বিয়ে ও সন্তান ধারণ, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো ও জিনগত প্রভাব। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, অনেকেই প্রাথমিক লক্ষণকে গুরুত্ব দেন না। ফলে রোগ ধরা পড়ে দেরিতে।

প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসায় কতটা সফলতা পাওয়া যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে স্তন ক্যানসার সম্পূর্ণরূপে নিরাময় সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশেই অত্যাধুনিক কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে। আগে যেসব চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হতো, এখন সেগুলো দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। তাই সময়মতো রোগ শনাক্ত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

স্তন ক্যানসার শনাক্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি সম্পর্কে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, প্রথম ধাপে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শে ম্যামোগ্রাম বা আলট্রাসনোগ্রাম। এ পরীক্ষাগুলো বয়স, পারিবারিক ইতিহাস ও শারীরিক উপসর্গ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়।

ক্যানসার চিকিৎসার সময় মানসিক সমর্থনের গুরুত্ব সম্পর্কে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসাও সমান জরুরি। রোগীর আত্মবিশ্বাস, পরিবার ও বন্ধুদের ভালোবাসা, কর্মক্ষেত্রে সহায়তা—এসব রোগমুক্তিতে ভূমিকা রাখে। ক্যানসারকে জীবনের ‘শেষ’ নয়, ‘একটি যাত্রা’ হিসেবে দেখতে হবে।

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস ও চিকিৎসাসুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. এ টি এম কামরুল হাসান

অনেক নারী লজ্জা বা ভয় থেকে পরীক্ষা করাতে চান না—এ অবস্থায় কীভাবে সচেতনতা বাড়ানো যায়? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, সমাজে এখনো ক্যানসার, বিশেষ করে স্তন ক্যানসার নিয়ে ভুল ধারণা আছে। মিডিয়া, পরিবার, স্বাস্থ্যকর্মী—সবাই মিলে নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালালে নারীরা সাহস পাবে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

ক্যানসার রোগীদের জন্য হাসপাতালভিত্তিক সহায়তা বা কাউন্সেলিংয়ের সহজলভ্যতা প্রসঙ্গে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, এখন বাংলাদেশে বেশ কিছু ক্যানসার হাসপাতালে কাউন্সেলিং সেন্টার রয়েছে। এগুলো রোগীদের মানসিকভাবে শক্ত থাকতে সাহায্য করে।

স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে নারীরা কী কী জীবনধারা অনুসরণ করতে পারেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাবার, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার এবং সন্তান জন্মের পর অন্তত ছয় মাস বুকের দুধ খাওয়ানো—এসব বিষয়ই কার্যকর প্রতিরোধে সাহায্য করে। পাশাপাশি ৩০ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত নিজের পরীক্ষা ও ৪০ বছর পর থেকে বছরে একবার ম্যামোগ্রাম করা উচিত।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে উপস্থাপক এ রোগে আক্রান্ত নারীদের প্রতি সমাজ ও পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চান। ডা. এটিএম কামরুল হাসান বলেন, ‘সবচেয়ে আগে দরকার সহানুভূতি ও সহায়তা। অনেক সময় রোগীরা সামাজিক চাপ ও ভয়ের কারণে চিকিৎসা নিতে দেরি করেন। পরিবার যদি শুরু থেকেই পাশে থাকে, তাহলে চিকিৎসা গ্রহণ সহজ হয়। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। স্তন ক্যানসার কোনো লজ্জার বিষয় নয় বরং এটি একটি নিরাময়যোগ্য রোগ।’

সবশেষে উপস্থাপক জানতে চান, বাংলাদেশ কি ক্যানসার-চিকিৎসায় স্বনির্ভর? উত্তরে ডা. এটিএম কামরুল হাসান বলেন, ‘হ্যাঁ, এখন বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, অভিজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স, এবং চিকিৎসার মান-সবই দ্রুত উন্নত হয়েছে। রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন অনেক কমে গেছে।’