
দেশজুড়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নে সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত ও সমাধানে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পলিসি ডায়ালগ’ আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার হোটেল শেরাটন, বনানীতে আয়োজন করা হয়। বেসরকারি সংস্থা পপি ও বিডিওএসএন-এর যৌথ উদ্যোগে মালালা ফান্ডের সহায়তায় এ ডায়ালগের আয়োজন করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, নারী অধিকার বিশেষজ্ঞ, উন্নয়নকর্মী ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ডায়ালগের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। সংলাপের শুরুতে মাইলস্টোন স্কুলে নিহত শিশুদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সংলাপে স্বাগত বক্তব্যে পপির নির্বাহী পরিচালক মুর্শেদ আলম সরকার বলেন, ‘আমরা যত উন্নয়ন কার্যক্রমই পরিচালনা করি না কেন, যদি বাল্যবিবাহ রোধ করতে না পারি, তবে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে না, বরং বারবার বাধাগ্রস্ত হবে।’
এরপর পপির উপপরিচালক সিনা চৌধুরী, মাঠপর্যায়ের ওয়ার্কশপ থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও তথ্য-উপাত্ত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি বিশ্লেষণী ফলাফল উপস্থাপন করেন।
সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্যানেল ডিসকাশন। বিডিওএসএন-এর সভাপতি মুনির হাসানের সঞ্চালনায় প্যানেলিস্ট হিসেবে ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী, ঢাকা, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাজ্জাদুল ইসলাম, মালালা ফান্ডের সাবেক কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মোশাররফ তানসেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক স্বপন কুমার হালদার এবং পপির পরিচালক ফেরদৌসি বেগম।
প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, শুধু সরকারের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে আইন প্রয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। তিনি আরও জানান, সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর ধারা ১৯ সংশোধনের কাজ চলমান রয়েছে। তিনি জানান, ‘আমরা “কুইক রেসপন্স টিম” গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে প্রায় ৬ হাজার ২০০টি টিম গঠন করা হবে, যারা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে কাজ করবে।’
মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, সমাজকর্মীর অপ্রতুলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ৫০০ সমাজকর্মী শিশুদের জন্য নিয়োজিত করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আরও সমাজকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। স্বপন কুমার হালদার বলেন, নিবন্ধনপ্রাপ্ত অর্গানাইজেশনগুলো যদি বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করে, তাহলে বিষয়টি ভালো হয়। উপজেলাকর্মী গ্রাম পুলিশকে গুরুত্ব দেন। তরুণদের একটা দল তৈরি করা যায়, যারা বাল্যবিবাহের খবর জানিয়ে দেবে।
সংলাপের শেষ ভাগে আলোচনার ভিত্তিতে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো কীভাবে একটি ব্যবহারিক অ্যাডভোকেসি টুলকিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং কীভাবে তা নীতিনির্ধারণ সহায়ক হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়।
সমাপনী বক্তব্যে পপির উপনির্বাহী পরিচালক সাজেদুল হাসান অংশগ্রহণকারী, প্যানেল সদস্য ও অংশীদারদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
এ আলোচনা একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে সরকারি প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদেরা শিশুদের অধিকার রক্ষা, আইন প্রয়োগ এবং বাল্যবিবাহের মূল কারণ ক্ষতিকর সামাজিক রীতিনীতি দূর করতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। এ প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মেয়েদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার গুরুত্ব নিশ্চিত করা। কারণ, শিক্ষা শুধু বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের একটি রক্ষাকবচই নয়, এটি মেয়েদের ক্ষমতায়ন, সমতা ও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পরিবর্তনের একটি প্রধান শক্তি।