যেভাবে চলে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিমুহূর্তে আসছে নানা ধরনের রোগী
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

জরুরি বিভাগ হচ্ছে হাসপাতালের সবচেয়ে সরগরম জায়গা। রোগী আর চিকিৎসক দিয়েই শুধু এই বিভাগের চত্বর ভরা থাকে—বিষয়টা মোটেও এমন নয়। অ্যাম্বুলেন্স বা অটোরিকশার চালক, আয়া, পানিওয়ালা থেকে শুরু করে পানের দোকানদারদের সমাবেশস্থল হচ্ছে জরুরি বিভাগের সামনের জায়গা। প্রতিমুহূর্তেই সেখানে ঘটছে নতুন নতুন ঘটনা।

মাথায় গামছার ফেটি বাঁধা একজনকে নামানো হচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে। আরেকজন কাত হয়ে আছেন রিকশায়। তখনই হয়তো মুমূর্ষু কাউকে স্ট্রেচারে করে নামানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স থেকে। সঙ্গে থাকা নারী কাঁদছেন অজানা আশঙ্কায়। এরই মধ্যে ক্লান্ত হয়ে কেউ একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন, কেউ আবার ফলের দামদর করছেন।  

জরুরি বিভাগে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি রোগী আসেন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ রোগী অন্যান্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক, পরিচালক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রবেশমুখে গাছের তলায় রীতিমতো গামছা বিছিয়ে ভাতঘুম দিতেও দেখা যায়। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এখন শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ভিড়। তবে জরুরি বিভাগে চাপ তুলনামূলক কম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সব সময় গমগম করছে মানুষে। রাজধানীর চারটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশি।  

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঝুম বৃষ্টির ভেতর এক তরুণকে কোলে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে দৌড়ে এসেছিলেন তাঁর ভাই। পেছন পেছন হাতপাখা নিয়ে তাঁদের মা। আর বাবার হাতে কিছু কাগজপত্র। রোগী দেখেই বোঝা গেল অবস্থা গুরুতর। অসুস্থ কেন জানতে চাইলে রোগীর মা বললেন, কাশির সিরাপ বেশি খেয়ে ফেলেছে ছেলে। বেশি খেয়েছে কেন, তা জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ভেষজ ওষুধ মনে করেছে। ততক্ষণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে আসা ওই রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জরুরি বিভাগের সামনে। ভাই গিয়ে কিনে আনলেন সেবা নেওয়ার ১০ টাকার টিকিট। চিকিৎসক ছুটে এলেন। রোগী দেখে নির্দেশ দিলেন, এখনই পেট পরিষ্কার করাতে হবে।

গতকাল বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসক সাদেকুল হক তুহিন বললেন, রোগী আসলে সেডাটিভ খেয়েছে। পেট পরিষ্কার করার পর বোঝা যাবে শরীরের অবস্থা। সে হিসেবেই চিকিৎসা দিতে হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ

যাত্রাবাড়ীর তরুণকে পাঠানো হলো পেট পরিষ্কার করাতে। চিকিৎসক জানালেন, এমন ঘটনা ঘটলে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে এলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এর বেশি সময় গড়িয়ে গেলে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। তবে সবকিছু নির্ভর করে রোগী কোন ওষুধ কী পরিমাণ খেয়েছে, তার ওপর। জরুরি বিভাগে চিকিৎসকদের পাশে বসে এক ঘণ্টায় কত ধরনের রোগী আসে তার একটি নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছিল।

এর মধ্যে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে উত্তরা থেকে আসা আসমা বেগমকে (ছদ্মনাম) পাঠানো হলো মেডিসিন ওয়ার্ডে। তাঁর ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে ছিলেন এক শিশুর বাবা। জায়গা পেতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন চিকিৎসকের সামনের টেবিলের বর্ধিত কাঁচের ওপাশে। জানালেন, মেয়ের জ্বর ১০৩–এর নিচে নামছে না। তখনই তাঁকে পাঠানো হলো ২০১২ নম্বর কক্ষে—শিশু বিভাগে।  

এক মুহূর্ত ছাড় নেই। রোগী আসছে তো আসছেই। কেউ মারামারি করে মাথা ফাটিয়েছেন। কোনো রোগীর কাটা হাতের ব্যান্ডেজ থেকে তখনো রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে ডায়াবেটিসের এক রোগী এসেছেন পায়ে সংক্রমণ নিয়ে। রোগীদের প্রতি চারজনের একজন বলছেন জ্বরের কথা। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানালেন, ডেঙ্গুর জন্য জ্বরের রোগীর সংখ্যা এখন বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ডেঙ্গুর জন্য বিশেষায়িত না হলেও এখানে ছুটে আসছেন রোগীরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক প্রথম আলোকে বললেন, জরুরি বিভাগে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি রোগী আসেন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ রোগী অন্যান্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা। তারা জানে, অন্য কোনো হাসপাতাল রোগী না নিলেও এখানে এলে ব্যবস্থা হবে। ফলে সারা দেশ থেকে রোগী আসতে থাকে।

এবার এই রোগীর সংখ্যাকে ২৪ ঘণ্টা দিয়ে ভাগ করলে বুঝতে পারবেন, প্রতি ঘণ্টায় জরুরি বিভাগে কতজন করে রোগীকে সেবা দিতে হয়। সে হিসাবে ১ হাজার ৪৪০ মিনিটের একটি দিনে প্রতি মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা নিচ্ছেন একজনের বেশি রোগী।

জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে আগে নির্ণয় করতে হয় রোগী কোন বিভাগে যাবে—মেডিসিন, প্রসূতি, অর্থোপেডিক না জরুরিভাবে তাঁর অস্ত্রোপচার করতে হবে। পরে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেই বিভাগে। এর মধ্যে বিষ পান করা গুরুতর রোগী যেমন আছেন, তেমনই আছেন সামান্য মাথাব্যথার রোগীও। চিকিৎসককে প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য রোগী দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কে কোন শ্রেণির। এই প্রক্রিয়াকে চিকিৎসকেরা বলেন, প্রাথমিক নির্ণয়করণ।

এ নিয়ে কখনো কখনো ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। জরুরিভাবে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীর স্বজনের প্রত্যাশা থাকে, টিকিট কেটেই তাঁরা যে চিকিৎসককে পাবেন তিনিই সেবা দেবেন। বাস্তবিকভাবে তা অসম্ভব। অন্তত একবেলা জরুরি বিভাগে দাঁড়িয়ে শত শত রোগী দেখে তা মনে হয়েছে।

গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে আরিফ নামের একজন রোগী এসেছিলেন আতঙ্ক নিয়ে। এত ভিড়ের মধ্যেও দুই বাক্যে আলাপ করতে করতে চিকিৎসক বের করে ফেললেন, রোগী ড্রাগন ফল খেয়েছে বেশি। ফলে তাঁর প্রস্রাবের রং বদলে গিয়েছে। যা দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এসেছেন। তাঁকে পাঠানো হলো মেডিসিন বিভাগে।

চিকিৎসক সাদেকুল হক বললেন, ‘বুঝলেন অবস্থা?’ বোঝা গেল জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই করতে হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বললেন, রাতের জরুরি বিভাগ না দেখলে বুঝতেই পারবেন না এখানে প্রতি মুহূর্তে কত রকম ঘটনা ঘটে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত অসম্ভব চাপ থাকে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী পাঠানো হয়। আর তাঁর সঙ্গে থাকা স্বজনেরা থাকেন বেশি উদ্বিগ্ন। এই জায়গা তখন নানা রকম মানুষে ভরে যায়।  

গতকাল সন্ধ্যায় জরুরি বিভাগ থেকে ফিরে আসার সময়ও অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। অন্ধকারের ভেতর সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামলেন এক দম্পতি। পুরুষের কোলে একটা তোয়ালের ভেতর উঁকি দিচ্ছে সদ্য জন্মানো এক শিশুর মুখ। তার চোখ বন্ধ, বৃষ্টির ছাঁট লাগছে মুখে।

উদ্বিগ্ন মা–বাবার তখন ভাবনা ঠিকঠাক কাজ করছে না। টিকিট কাটার কথা খেয়াল নেই। ভুল করে সাংবাদিককেই ভাবলেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক। শিশুটিকে সামনে এগিয়ে দিয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বাচ্চা চোখ খোলে না কেন?’ তখন কেউ একজন দেখিয়ে দিলেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কক্ষ।