
মাঠটির আয়তন চার একর। চারপাশে ইট বিছানো হাঁটাপথ। সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় নানা বয়সী মানুষের পদচারণ। পূর্ব পাশে ব্যাডমিন্টন ও বাস্কেটবল কোর্ট, সুইমিং পুল, ছোট জিমনেসিয়াম, শিশুদের ছোটখাটো রাইড। আর বিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত সবুজ সমতল মাঠ। এই শুকনো মৌসুমেও অম্লান ঘাসের সবুজ।
কোনো ব্যক্তির বা বাণিজ্যিক উদ্যোগ এটি নয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এ মাঠ গুলশানের ১০৯ নম্বর সড়কে। এখন ডিএনসিসির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এর রক্ষণাবেক্ষণ করছে গুলশান ইয়ুথ ক্লাব। কংক্রিটে ঠাসা পরিপার্শ্বের মধ্যে মাঠটি শিশুদের কাছে একটুখানি প্রাণের স্পর্শ। মা-বাবার সঙ্গে শনিবার সকালে মাঠে এসেছিল নবম শ্রেণির ছাত্রী মাহবুবা জেরিন। বলল, ‘সকাল থেকে ক্লাস। বাড়ি ফেরা সন্ধ্যায়। আবার পড়া, টিভি, কম্পিউটার। কোথাও খোলা জায়গায় বেড়ানোর উপায় নেই। সপ্তাহের ছুটির দুটি দিন এই মাঠে আসা আমার জন্য খুব আনন্দের।’ তার বাবা প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বলছিলেন, এ মাঠের নিরাপত্তা ভালো। এখানে আসার এটাও একটা কারণ। সামান্য কিছু খরচে নানা খেলার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এমন ব্যবস্থা এ শহরে বিরল।
ঢাকা শহরে যে মাঠগুলো এখনো কোনোমতে টিকে আছে, সেগুলোর অবস্থা তথৈবচ। মাঠে আছে তো ঘাস নেই, কোনো মাঠে নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, একটু বৃষ্টি হলেই কোনোটি হয়ে যায় এঁদো ডোবা। কোনো মাঠ মাদকাসক্তের আখড়া তো কোনোটি আবার উন্নয়নের নানা প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দখলে। গোলাপবাগ থেকে লালবাগ, মোহাম্মদপুর থেকে তেজগাঁও, শ্যামলী থেকে বনানী মাঠ—দুই সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ মাঠের অবস্থা মোটামুটি এমনই। এই অবস্থার বিপরীত চিত্র গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের মাঠটি।
গুলশান ইয়ুথ ক্লাব মাঠটিও একসময় অন্য মাঠগুলোর মতোই ছিল। ক্লাবটির জন্ম ১৯৭৭ সালে। মাঠের একচিলতে জায়গায় ক্লাবের ক্রিকেটাররা খেলতেন। পশ্চিম পাশে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক শিশুপার্ক। পূর্ব পাশটি দখল করেছিল এক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। স্থানীয় বাসিন্দা ইকতেদার আহমেদ বললেন, অবশিষ্ট ছোট অংশটিতেও যখন-তখন লেগে থাকত মেলা, কনসার্ট এসব।
রাজউকের এ মাঠ ঢাকা সিটি উত্তর করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে। ২০১২ সালে বাণিজ্যিক শিশুপার্কটি তুলে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ করা হয় অবৈধ স্থাপনা। গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের উপদেষ্টা রাফিজ আলম চৌধুরী বলেন, ‘মাঠ উদ্ধারের সময় আমাদের অনেক হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা পিছপা হইনি।’
মাঠের ব্যবস্থাপনা নেওয়ার পর ইয়ুথ ক্লাব এর পরিচর্যা শুরু করে। তৈরি হয় বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল। এখন ইনডোর ও আউটডোর মিলিয়ে ২০টি খেলা হয় এ ক্লাবে। আছে শিশুদের জন্য এসব খেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ফি দিয়ে এ প্রশিক্ষণ নিতে পারে শিশুরা।
সরকারি কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের ছেলে রাইমান ওয়াসিফকে বাস্কেটবল খেলাতে নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘বাসার আশপাশে কোথাও খেলার ব্যবস্থা নেই। এখানে যে নামমাত্র মূল্যে প্রশিক্ষণ ও খেলার সুযোগ, তা কোথাও পাব না।’
গুলশান অভিজাতদের এলাকা। এ মাঠের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গুলশান ইয়ুথও ক্লাব সমাজের বিত্তশালীদের সংগঠন। তবে মাঠটি কেবল বিত্তবানদের নয়। মাঠে ঘুরে অন্তত চারজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কেউই ক্লাবের সদস্য নন। তাঁদের একজন গৃহবধূ ইশরাত ইমন বললেন, ‘সকাল-সন্ধ্যা হাঁটতে আসি। কেউ তো নিষেধ করে না।’
গুলশানের এ মাঠ ব্যতিক্রম আরেকটি কারণে। খেলাধুলার কোর্টের পাশে একটি ছোট্ট পাঠশালা। সেখানে সুবিধাবঞ্চিত ৫৭টি শিশু লেখাপড়া করে। ওরা লেখাপড়ার পাশাপাশি এখানে খেলতে পারে। রাফিজ আলম চৌধুরী বললেন, সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভুলে যাক। সব মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হোক। সে জন্যই এই স্কুলটি করা হয়েছে।
নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, গুলশানের এ মাঠ ব্যবস্থাপনার একটি নজির স্থাপন করেছে। সিটি করপোরেশন স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে এ রকম উদ্যোগ নিয়ে মাঠ রক্ষা করতে পারে।
এমন উদ্যোগ কি সিটি করপোরেশন নেবে? ঢাকা ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক বললেন, ‘আমরা এলাকার মানুষকে মাঠের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই। এ মাঠ একটি ভালো উদাহরণ।’