করোনা-কালের জীবনগাথা-৩৫

ঘরবন্দী মায়েরা

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

করোনার ছোবল কোথায় কীভাবে পড়েছে, জ্ঞানী–গুণীরা নিশ্চয়ই তার হিসাব করবেন। কিন্তু তার এক ছোবল যে এসে পড়েছে পারিবারিক জীবনে, তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দিতে পারি। গৃহকর্মীদের বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় সবাই। আর এই ঘরবন্দী জীবনে মায়েরা নতুনভাবে নিজেদের আবিষ্কার করেছেন গৃহশ্রমিক হিসেবেও।

নিজের গল্পটাই বলি। একদিন হঠাৎ চোখের কোণে ব্যথা। সময় যত গড়াচ্ছে, ব্যথাও তীব্র হয়ে উঠছে। সামনের দিকে ঝুঁকলেই মনে হচ্ছে পুরো চোখ ছিটকে বেরিয়ে আসবে। কাউকে বুঝতে দিলাম না। কেই–বা কী করতে পারবে? কোনো রকমে ঘর মুছলাম। এর পর আর ব্যথা সইতে না পেরে শুয়ে পড়লাম। মেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে আম্মু? বললাম, কিছু হয়নি।

তখন রোজার মাস। ইফতারের সময় হয়ে এল। শোয়া থেকে উঠতেই আবারও চোখে ব্যথা। কিন্তু উপায় নেই। রান্নাঘরে গিয়ে চুলা জ্বালিয়েছি। গরমে ব্যথা টনটন করতে লাগল। ভাবলাম, স্বামী–সন্তানদের গিয়ে বলি, আজ তোমরাই ইফতারটা তৈরি করো। আবার ভাবলাম, করোনায় এমনিতেই সবার একঘেয়ে জীবন। এর ওপর আমার অসুস্থতার কথা জেনে ফেললে সবাই অস্থির হয়ে পড়বে। এর চেয়ে ভালো, চুপ করে থাকা। খুব কষ্ট করে ইফতারি তৈরি করলাম। চোখটা ততক্ষণে অনেক ফুলে উঠেছে। সবাই টের পাবে বলে চোখ আড়াল করে রাখলাম।

ইফতারের পরও ব্যথা কমার নাম নেই। কিন্তু শুয়ে থাকলে কি আর চলে। ব্যথা নিয়েই কোনোভাবে কাজ সারছি। রাতে নামাজ শেষে যে যার মতো শুয়ে পড়ল। আমি চেষ্টা করেও কিছুতেই ব্যথায় চোখ বন্ধ করতে পারছি না। আবিষ্কার করলাম, চোখের কোণে ছোট্ট একটা দানার মতো হয়েছে। একটা ছোট্ট ফোঁড়ার এত ক্ষমতা? কোনোভাবেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ঘরে পায়চারি শুরু করলাম। একবার ভাবলাম, আমার স্বামীকে ওঠাব কি না। ওর গভীর নিদ্রামগ্ন চেহারার দিকে তাকাতেই মায়া লেগে গেল, গভীর ঘুম! ছেলেমেয়েদের বলেই বা কী লাভ। ওরা তো বেশ ছোটও।

ভীষণ কষ্টের একপর্যায়ে ওষুধ খেতে হলো। এরপর পায়চারি করছি আর দোয়া পড়ছি। অনেকক্ষণ পর ব্যথা সামান্য কমলে সে ব্যথা নিয়েই শুয়ে পড়লাম।

ঘুম তেমন হলো না বলে মাথাব্যথাটা সারল না। সাহ্‌রিতে উঠে সবাই মিলে খাওয়া–দাওয়া শেষ করলাম। দেখি, আস্তে আস্তে ব্যথাটাও বাড়ছে। ভাবছি, এবার সবাইকে বলি। কিন্তু ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর ওদের বাবার সঙ্গে দুষ্টুমি করছে। ভাইবোনেরা খুনসুটি করছে নিজেদের মধ্যে। এ দৃশ্য কি ভেঙে দেওয়া যায়?

মনে হলো, আমার ছেলের চোখে একবার অঞ্জলি ওঠার পর দেওয়া ডাক্তারদের চিকিৎসাটা মানলে কেমন হয়। কিছু বরিক পাউডার গরম পানিতে মিশিয়ে সেঁক দিলাম। কেউ যাতে টের না পায়, সে জন্য কেউ কামরায় না থাকলে তখন সেঁক দিতাম। দু–একবার কেউ কেউ টের পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? পাশ কাটিয়ে বললাম, তেমন কিছু না।

পর দিন সকালে দানাটা পাকল। সেটা পরিষ্কার করে মনে হলো, শরীরের ওপর থেকে ব্যথার বোঝাটা নেমে গেল। সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভাবলাম, বাসার আর সবার ওপর কাজের ভার চাপিয়ে দিলেই হতো? আসলে মায়ের কাছে এসে বাচ্চারা নির্দ্বিধায় যা খুশি বলতে পারে। ছেলেমেয়ের বাবা এসে বলতে পারে তার দুঃখের কথা। কিন্তু কজন মা বলতে পারে, তারও ভালো লাগছে না।

আমার ছেলে করোনা নিয়ে নতুন কোনো তথ্য পেলেই আমাকে এসে জানায়। সংক্রমণ বা মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেলে ও নার্ভাস হয়ে পড়ে। তখন ওকে সাহস দিয়ে বলি, জন্ম যখন হয়েছে, মৃত্যু হবেই। এটাই বাস্তব। অযথা চিন্তা কোরো না। মনে হলো, ছেলেমেয়েরা কিছুটা হলেও মনোবল ফিরে পেয়েছে। কিন্তু আমার যখন আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে, আমাকে কে এমন করে সাহস দেবে!

পৃথিবী একদিন করোনামুক্ত হবে। পত্রিকায়, টিভিতে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে হয়তো এই খবর আসবে যে করোনাকালে কিছু ডাক্তার, পুলিশ আর সমাজসেবী নিরলসভাবে রোগীদের সেবা দিয়েছেন। তাঁদের হয়তো সম্মানিতও করা হবে। কিন্তু এই কঠিন সময়ে ঘরে থেকে মায়েরা যেভাবে যত্ন করে পরিবারের সদস্যদের আগলে রেখেছেন, তা কে স্মরণ করবে! কেউ স্মরণ করুক বা না করুক, পৃথিবীর সব মায়ের প্রতি সব মায়ের পক্ষ থেকে রইল দোয়া।