‘ভালো কাজের’ বিনিময়ে খাদ্য-চিকিৎসা-শিক্ষা

পবিত্র রমজানে শিশুদের জন্য ইফতারের আয়োজন
ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ূন আহমেদের ‘সবুজ ছায়া’ নাটকের একটা চরিত্র আরিফুর রহমানের মনে গেঁথে যায়। নাটকে একটি চরিত্রকে প্রতিদিন একটা ভালো কাজ করতে দেখা যায়। সেই থেকে আরিফুর নিজেও প্রতিদিন একটা করে ভালো কাজ করার চেষ্টা করতে থাকেন। অন্যদেরও ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে একপর্যায়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন সংগঠন। ভালো কাজের বিনিময়ে এ সংগঠন এখন মানুষকে খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাগত সহায়তা দিচ্ছে।

সংগঠনটির নাম ‘ভালো কাজের হোটেল’। সংগঠনটির নামের সঙ্গে ‘হোটেল’ শব্দটি থাকলেও তা আদতে ‘হোটেল’ নয়। এটি আসলে মানবসেবামূলক একটি সংগঠন। এর উদ্দেশ্য দরিদ্র-অসহায়-ছিন্নমূল মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাঁদের সহায়তা করা।

পবিত্র রমজানে দরিদ্র-অসহায়-ছিন্নমূল মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন

২০০৯ সাল থেকে ভালো কাজ করার পাশাপাশি মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধের চেষ্টা করে আসছেন আরিফুর ও তাঁর বন্ধুরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষকে সহায়তামূলক উদ্যোগের শুরু বলে জানালেন আরিফুর। ২০০৯ সালে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামনে এক দরিদ্র বাবা তাঁর মেয়ের অস্ত্রোপচারের জন্য অর্থসহায়তা চাইতে আসেন। এই বাবাকে সহায়তায় এগিয়ে আসেন আরিফুর ও তাঁর বন্ধুরা। তাঁদের সহযোগিতায় মেয়েটির সফল অস্ত্রোপচার হয়। মেয়েটির বাবা এ সহযোগিতা পেয়ে আরিফুরদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সবার জন্য দোয়া করেন। এ ঘটনায় আরিফুররা খুবই উৎফুল্লবোধ করেন। তারপর তাঁরা আরও ভালো কাজে নেমে পড়েন।

শুরুর দিকে আরিফুররা উৎসব বা বিশেষ দিনগুলোতে দরিদ্র-অসহায়-ছিন্নমূল মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে থাকেন। এ ছাড়া তাঁরা বিভিন্ন ধরনের সহায়তামূলক কাজ করতে থাকেন। ১২ থেকে ১৩টি শিশুর চিকিৎসায় সহায়তা করা আরিফুরদের নিয়ে ২০১০ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ একটি প্রতিবেদন করে। ইত্যাদিতে প্রতিবেদন প্রচারের পর তাঁদের দলে আরও লোক যোগ দেয়।

ঢাকায় সাহ্‌রি বিতরণ

২০১১ সাল থেকে আরিফুররা প্রতিটি ঈদের দিন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু ও অসহায় মানুষদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালে তাঁদের নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন করে ইত্যাদি। ২০১৯ সাল থেকে তাঁরা প্রতি সপ্তাহে এক দিন ছিন্নমূল-অসহায় মানুষের জন্য রান্না শুরু করে। দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে তাঁরা প্রতিদিন মানুষকে খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন। এ উদ্যোগকে একটা আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে তাঁরা ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘ভালো কাজের হোটেল’ নামের সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য—ভালো কাজের বিনিময়ে খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়া।

ভালো কাজের হোটেলে কোনো চেয়ার-টেবিল নেই। নেই বেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। মাথার ওপরে নেই ছাদ। খোলা আকাশের নিচে চলে কার্যক্রম।
প্রতিদিন ভালো কাজের হোটেলে আসা ব্যক্তিদের নাম ও বয়স লিখে রাখা হয়। কে কী ভালো কাজ করেছেন, তা–ও লিখে রাখা হয়। সপ্তাহে এক দিন সেরা তিনটি ভালো কাজের ওপর সংগঠনটি পুরস্কার দেয়।

শিশুদের শিক্ষায় সহায়তা করছে সংগঠনটি

আরিফুর জানালেন, ভালো কাজের হোটেলের বর্তমানে চারটি শাখা রয়েছে। অর্থাৎ চারটি স্থানে তাঁরা খাদ্যসহায়তার কার্যক্রম চালান। চারটি শাখার মধ্য তিনটি ঢাকায়, একটি চট্টগ্রামে। ঢাকার তিনটি ‘হোটেল’ কমলাপুর, বনানী ও হাতিরঝিলে অবস্থিত।

পবিত্র রমজানের সময় কমলাপুর, বনানী, হাতিরঝিলের পাশাপাশি কারওয়ান বাজার ও বাসাবোতে ইফতারের আয়োজন করছে সংগঠনটি। এ ছাড়া চট্টগ্রামেও একই কার্যক্রম চালু আছে। এই ছয়টি স্থানে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার দরিদ্র মানুষকে ইফতারি দিচ্ছে ভালো কাজের হোটেল। এ ছাড়া ২০০ থেকে ৩০০ জনের মধ্যে তারা সাহ্‌রি বিতরণ করছে।

সাধারণ সময়ে এ সংগঠনের উদ্যোগে নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিদিন একবেলা অসহায় মানুষদের খাবার দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে অসহায়, ছিন্নমূল, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদের সামনে সাহায্যপ্রার্থী অসহায় মানুষদের খাবার দেওয়া হয়। আশপাশের এতিমখানার এতিম শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।

সংগঠনটির সহায়তায় ঢাকার বাসাবো ও বাড্ডার পাশাপাশি মাদারীপুরে ৩টি স্কুলে ৭০০ জনের বেশি শিশু বিনা মূল্যে পড়ালেখা করছে। তাদের পুষ্টিকর খাবারও দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সংগঠনটি এখন পর্যন্ত ৩০০ জনের বেশি শিশুকে চিকিৎসায় সহায়তা দিয়েছে।

সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েক শ শিশুকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে

ভালো কাজের হোটেলের বর্তমানে সদস্যসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০। তাঁদের ‘ডেইলি টেন মেম্বার’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁরা প্রতিদিন ১০ টাকা করে জমা করেন। মাস শেষে সবার কাছ থেকে জমা টাকা সংগ্রহ করে তা সেবার কাজে ব্যয় করে সংগঠনটি। আরিফুর জানালেন, শুরুর দিকে শুধু সদস্যদের সহায়তায় সংগঠনের কার্যক্রম চলত। পরে ভালো কাজের হোটেলের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এগিয়ে আসেন, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।

ভালো কাজের হোটেলের মূল উদ্যোক্তা আরিফুর। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ করে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তিনি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় থাকেন। তাঁর স্ত্রী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

আরিফুর বলেন, ‘দরিদ্র-অসহায় মানুষের কষ্ট লাঘবের পাশাপাশি তাঁদের ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করাই আমাদের এ উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য। এ কাজ করে আমদের নিজেদেরও খুব ভালো লাগে। আমরা অন্যদেরও ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করছি। এভাবেই একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি। আরও মানুষ এগিয়ে এলে আমাদের সেবার পরিসর বাড়ানো যাবে।’