
ঢাকার কুড়িল থেকে সদরঘাটের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার; এক বিকালে গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছিল যানজট ধরে গাড়িতে এই পথ পাড়ি দিতে ১ ঘণ্টা ২৪ মিনিট লাগবে, আর যানজট না থাকলে পৌঁছনো সম্ভব ৩১ মিনিটেই। এই পথ বাসে যেতে কত সময় লাগে, বুঝতে চাইলাম এক কর্মদিবসে।
৯ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার; সকাল ৮টায় কুড়িল থেকে চাপলাম বাসে। ভিক্টর ক্ল্যাসিক নামে বাসটিতে ওঠার পর মনে হলো, প্রাচীনকালের এক যানবাহনে উঠেছি; যাত্রীসেবা দিতে দিতে গাড়িটি তার নিজের অবস্থার কোনো উন্নতি করতে পারেনি। বাসের ভেতরে পেছনের দিকে জানালার পাশে একটি ফাঁকা আসন পেলাম, বসতে যেতেই হাঁটু ঠেকে গেল সামনের আসনের সঙ্গে। কোনোমতে জড়োসড়ো হয়েই বসতে হলো।
সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, রাজধানীতে চলাচল করা মিনিবাসের আসনসংখ্যা হবে চালকেরটিসহ ৩১টি। কিন্তু এই বাসে মোট ৩৯টি আসন। ফলে জড়োসড়ো হয়েই বসতে হচ্ছে যাত্রীদের। এর বাইরে দাঁড়িয়ে ও বাসে ওঠার প্রবেশমুখেও ছিল কর্মস্থলমুখী মানুষের পথ পাড়ি দেওয়ার লড়াই।
ঢাকায় চলাচলরত অধিকাংশ বাসের বাইরে যেমন রংচটা, ভেতরটাও অপরিচ্ছন্ন। আসনের কভারগুলোও ময়লা জমে জমে তেল–চিটচিটে। ‘লক্কড়ঝক্কড়’ এই বাস নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হলেও চিত্র বদলায়নি। পুরোনো এসব গাড়ির মান উন্নত না হওয়ার জন্য মালিক এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবকেই কারণ হিসেবে দেখা হয়।
ঢাকায় চলাচলরত অধিকাংশ বাসের বাইরে যেমন রংচটা, ভেতরটাও অপরিচ্ছন্ন। আসনের কভারগুলোও ময়লা জমে জমে তেল–চিটচিটে। ‘লক্কড়ঝক্কড়’ এই বাস নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হলেও চিত্র বদলায়নি।
কুড়িল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত নির্ধারিত স্টপেজ তিনটি। কিন্তু এ পথটুকুতে বাসটি থেমেছে ১১ বার। যাত্রীরা যেখানে নামতে ছেয়েছেন, নামিয়েছে। আর যাত্রী ওঠাতে দাঁড়িয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। এমন চিত্র অবশ্য রাজধানী ঢাকার সব সড়কেই, তা যানজটের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাসে পাশের আসনে বসে সদরঘাট যাচ্ছিলেন ঢাকার খিলক্ষেতের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. বেলাল হোসেন। গল্প–আলাপে জানলাম, খিলক্ষেতে তার একটি গাড়ি সারাইয়ের ছোট দোকান আছে। তারই কিছু যন্ত্রাংশ বানিয়ে আনতে ধোলাইখাল যাচ্ছেন তিনি। কথায় কথায় যানজটের প্রসঙ্গ এলে তিনি বলেন, সকাল সকাল রওনা দিয়েছেন যেন জ্যামে পড়তে না হয়। কিন্তু তাতেও যানজট এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তাঁর মতে, বাসগুলো নিয়ম মেনে চললে আরও তাড়াতাড়ি গন্তব্যে সহজে পৌঁছানো যেত।
কুড়িল থেকে প্রগতি সরণি হয়ে ব্যস্ত এই সড়কে বাস থামার নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থান নির্ধারিত থাকলেও তা মানা হয় না। কখনো কখনো ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলে কালেভদ্রে আইন মানতে চান বাসচালকেরা। এই বাসটিও ইচ্ছেমতো যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী উঠা–নামা করেই সামনে এগিয়ে চলছিল।
নতুন বাজার থেকে থেমে থেমেই গেছি সদরঘাটে। সকাল আটটার দিকে রওনা দিয়ে কর্মব্যস্ত দিনের সকালে সদরঘাট পৌঁছাতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। এর মধ্যে বড় ধরনের যানজটে পড়তে হয়েছে বাড্ডা লিংক রোড, রামপুরা ব্রিজ এলাকা, আবুল হোটেল, কাকরাইল, গুলিস্তান, সুরিটোলা, তাঁতীবাজার, বংশাল ও জনসন রোডে। রিকশার দখল এবং বাসচালকদের সড়ক আটকে যাত্রী উঠানামা করার কারণেই এই যানজট; কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘ সিগন্যালও যানজট বাড়িয়ে তোলে।
আগে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে সদরঘাট রুটের বাসের সর্বশেষ স্টপেজ থাকলেও বর্তমানে নতুন ইউটার্নের কারণে বাসগুলো ধোলাইখালের দিকে থেকে ঘুরে আসে। ফলে বর্তমানে সদরঘাটগামী যাত্রীদের নামতে হয় জনসন রোডের মুখে। এরপর রিকশায় যেতে হয় সদরঘাট। সেখানেও ভালোই ঝক্কি পোহাতে হয় যাত্রীদের। ব্যাটারি রিকশার দাপটে থমকেই থাকে সড়কটি।
সড়কে নিয়ম ভাঙা নিয়ে কয়েকজন বাসচালক ও তাঁদের সহকারীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা ‘জমা’র কথাই বলেন। ঢাকায় বাসচালকেরা প্রতিদিন ভোরে মালিককে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে গাড়িটি নেন। একাধিক চালক বলেন, এ জন্য মালিককে দিতে হয় ১ হাজার ৬০০ টাকা। এরপর তাঁদের সারা দিনের তেলের খরচ ও অন্যান্য খরচ দিয়ে তাঁদের নিজেদের আয়ের হিসাব করতে হয়। পথের যানজট হিসাব করে অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁদের নিয়ম ভাঙতে হয়, প্রতিযোগিতায় যেতে হয়; ট্রিপ বাড়ানোর হিসাব কষতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক জডি রোজেন ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরের ঢাকার যানজট নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘অন্য শহরগুলোয় দেখবেন, রাস্তার ওপর গাড়ি। আছেন পথচারীও। হয়তো কোনো উপলক্ষে রাস্তা বন্ধও থাকে। তাই সেখান দিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু ঢাকার অবস্থা ভিন্ন। ঢাকার রাস্তার যানজট একেবারে সীমার বাইরে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এমন ব্যাপক ও স্থায়ী যে এটা এ শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে।’
ঢাকার সড়কে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা বাস্তবিক অর্থে কার্যকর না থাকায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাতের ইশারায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খান। অথচ রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য বিগত দুই দশকে চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু তার সুফল পায়নি নগরবাসী।
প্রায় এক দশক পর এই সময়ে রোজেন ঢাকায় এলেও একই চিত্রই দেখতেন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত ২০১৮ সালে এক অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তোলে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে দ্রুততম সময়ে তড়িঘড়ি করে পাস হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। এতে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে একগুচ্ছ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল।
এরপর রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে নেওয়া হয় রুট রেশনালাইজডের উদ্যোগ, সিদ্ধান্ত হয় যে ঢাকার বাসগুলো রুট ধরে একেকটি কোম্পানির অধীনে চলবে। সেই উদ্যোগে কেরানীগঞ্জের ভাটারচর থেকে রাজধানী হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ছয় মাস না গড়াতেই সেই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে। এখন আবার তা বাস্তবায়নের তোড়জোড় চলছে, এবার তা সফল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
কুড়িল থেকে পুরান ঢাকা পৌঁছার পর জনসন রোডের মুখে থেকে আবার বাসে উঠলাম। গন্তব্য এবার মিরপুর–১২, ‘বিহঙ্গ’ পরিবহনের বাসটিও রংচটা; ভেতরের চেহারা আগেরটির মতোই। এটিও চলা শুরু করে থেমে থেমে। এই যাত্রায় প্রথম যানজট তাঁতীবাজার মোড়ে। মিনিট কয়েক পর জট ছুটলেও এবার বাস থেমে গেল যাত্রীর আশায়। নড়ছেই না, যেন এ পথের সব যাত্রীকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব একমাত্র তার!
জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম সড়কে অব্যবস্থাপনা আর নিয়ন্ত্রণহীনতার চিত্র। সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই। ফুটপাথে হাঁটার সুযোগ নেই বলে মানুষ হাঁটছেন সড়ক দিয়েই। রিকশা ও মালবাহী ভ্যান অহরহ আসছে উল্টোপথে।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়ি ছাড়লেও একটু এগিয়ে আবার থেমে গেল। এবার যানজট উন্নয়নকাজের কারণে। সুরিটোলার কাছাকাছি চলছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকাজ। সে জন্য কেটে রাখা হয়েছে সদরঘাটমুখী এ সড়ক পথের অর্ধেকের মতো। এ ছাড়া সড়কের ওপরই রাখা আছে নানা নির্মাণসামগ্রী।
আবার হকাররা ফুটপাত দখল করে রাখায় বাধ্য হয়ে সড়কে নামার কথা বলছেন পথচারীরা। তা–ও সড়কে গাড়ি চলাচলের গতিধীর করে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে পড়ল চিরচেনা গুলিস্তানের জটে। চারদিকের সড়কে গাড়িগুলোর চাওয়া দ্রুত পার হওয়ার। আর গণপরিবহনগুলোর অপেক্ষা যাত্রী তোলার। সে জন্য বাসগুলো দাঁড়িয়ে যায় সড়কের মাঝে, আড়াআড়ি কিংবা সড়ক বন্ধ করে, যেন এটি কোনো অপরাধই নয়! বিপরীতে তপ্ত রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে হাতে লাঠি আর মুখে বাঁশি বাজিয়ে গাড়িগুলোকে পার হওয়ার ইশারায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য।
যানজট আর যাত্রীর জন্য অপেক্ষার পর সিগন্যালের কয়েক গজ পেরিয়ে একজন যাত্রীর জন্য আবার থেমে গেল বাসটি। তার সঙ্গে অনেক মালামালের কার্টন। ছয় থেকে সাতটি কার্টন গাড়িতে তুলে চালকের আসনের পাশে রাখা হয়। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে পল্টন মোড়ের যানজটে আটকাতে হয়। এখানে সড়কবাতির খুঁটি গাড়ির ধোঁয়ায় কালো রং ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাতের ইশারায় গাড়িগুলোকে পার করছেন। মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া মেট্রোলাইনে কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন যাওয়া–আসা করছে। ট্রেনটি যত দ্রুত যাচ্ছে, ঠিক ততটাই মন্থর নিচের সড়কের গতি।
১৫ মিনিটেরও বেশি সময় লাগল পল্টন মোড় পার হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে আসতে। জাতীয় ঈদগাহের সামনের সিগন্যালে কিছুক্ষণ আবারও থেমে থাকতে হলো। মাথার ওপর দিয়ে শাঁ শাঁ করে মেট্রো পার হয়ে যাচ্ছে, তা দেখতে দেখতে নিচে সড়কে বসে অপেক্ষা বাড়ছিল।
দুই থেকে তিন মিনিট পর ট্রাফিক পুলিশের বাঁশি বাজল, হাতের ইশারায় পার হওয়ার অনুমতি পাওয়ার পর গাড়ি একটানে মৎস্য ভবন মোড়ে এসে থামল। একজন যাত্রী নামলেন, দুজন উঠলেন। বাসটি তার পেছনে থাকা আরেকটি বাসকে আটকানোর জন্য আড়াআড়ি করে দাঁড়ানোয় পেছনে জট লেগে গেল। পেছনে থাকা গাড়িগুলোর অনবরত হর্নের পর গাড়িটি সামনে এগোতে শুরু করল। শাহবাগ পর্যন্ত আর কোনো স্টপেজ না থাকলেও গাড়িটি থেমেছে তিনটি স্থানে।
শাহবাগ সিগন্যাল পার হতে মিনিট পাঁচেক লাগল। সিগন্যাল পার হয়ে এবার গাড়িটির অপেক্ষা যাত্রীদের জন্য। একটু এগিয়ে আসার পর আবার সিগন্যাল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে। এখানে বসানো হয়েছে আধা-স্বয়ংক্রিয় (সেমি অটোমেটেড) পদ্ধতিতে চলা নতুন সড়কবাতি। ফলে গাড়িগুলোর অপেক্ষা নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পর সড়কবাতিতে সবুজসংকেতের। এখানেও সিগন্যাল তদারকির জন্য রয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। আর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশ দিয়ে রমনা হয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়া ও আসার দুটি পথেই সতর্ক অবস্থান রয়েছে পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যদের।
ঢাকার সড়কে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা বাস্তবিক অর্থে কার্যকর না থাকায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাতের ইশারায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খান। অথচ রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য বিগত দুই দশকে চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু তার সুফল পায়নি নগরবাসী।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২২টি মোড়ে নতুন করে সংকেতবাতি (ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি) বসানো হচ্ছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এসব বাতি বসাতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। সংকেতবাতিগুলো তৈরি করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ইতিমধ্যে শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ কয়েকটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বাতি বসানো হয়েছে।
সবুজ বাতি জ্বলার পর গাড়ি সামনে এগোতে শুরু করল। একটানে গাড়ি এসে থামল বাংলামোটর সিগন্যালে। তা পার হয়ে যাত্রী উঠা–নামার প্রতিযোগিতায় থাকা বাসগুলোর কারণে আবারও লাগে জট। অথচ কয়েক হাত দূরেই একটি যাত্রীছাউনি ও বাস থামার নির্ধারিত স্থান রয়েছে। কিছু পথ এগিয়ে এবার কারওয়ান বাজার সিগন্যালে আটকে গেলাম। স্বয়ংক্রিয় সবুজ বাতি ও ট্রাফিক পুলিশের ইশারায় গাড়িগুলো সার্ক ফোয়ারা পার হয় ধীরে ধীরে। এ সময় যাত্রী উঠা–নামা হয় যথারীতি নিয়ম ভেঙেই। ফলে গাড়ির গতি কমে যায়। আর এখানে বিভিন্ন দিক থেকেই ব্যাটারি রিকশাগুলো চলছে ইচ্ছেমতো।
ধীরলয়ে যাত্রী উঠানামার পর বাস এগুতে থাকে। কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট যাওয়ার পথে এখন নতুন ইউটার্ন করা হয়েছে সড়ক বিভাজক কেটে। ফলে একটু সামনে এগিয়ে আবারও ধীরগতি ও যাত্রী উঠানামা। এরপর ফার্মগেট এলাকায় এসে যাত্রীর অপেক্ষায় বাস ঠায় দাঁড়িয়েছিল ১২ মিনিট। শুরুতে এসে দাঁড়াতে অসুবিধা হচ্ছে বলে বাসটি পেছন থেকে ধাক্কাচ্ছিল তার সামনে থাকা বাসটিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর যাত্রীদের চেঁচামেচি শুরু করেন, তখন অনেকটা অনিচ্ছা নিয়ে আস্তে আস্তে বাসটিকে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
বাসচালকদের চোখে যানজটের ক্ষেত্রে নতুন আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। এগুলো ঢাকার প্রায় সব সড়কেই এখন চলছে অবাধে। উল্টো পথে, সিগন্যাল ভেঙে, ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অননুমোদিত এই যানগুলো। তাদের সামলাতে ট্রাফিক পুলিশকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ফার্মগেট থেকে ইন্দিরা রোডের দিকে যাওয়ার এ পথে এসে নেমেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প। ফলে সড়কের অর্ধেকের বেশি (দুই লেন) আলাদা করা হয়েছে অস্থায়ীভাবে। ফলাফল যানজট। চালক কিছুটা কৌশল করে ডানে কেটে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামা গাড়ির লেনে ঢুকে পড়েন। এরপর সামনে গিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় বাসটি। খামারবাড়ি মোড় থেকে সোজা সামনে যাওয়ার রাস্তা অস্থায়ীভাবে বন্ধ থাকায় এখন গাড়িগুলোকে ইউটার্ন নিয়ে আসতে হয়।
এরপর একটানে জিয়া উদ্যানের সিগন্যালে এসে থামে বাসটি। মিনিটখানেক পর ছাড়া পেয়ে সামনে গিয়ে স্টপেজ ছাড়াই একজন যাত্রী তোলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার পথ থেকে। এরপর একটানে গিয়ে আগারগাঁও সিগন্যালে থামে। এভাবে থেমে, ধীরে এবং নিকটবর্তী বাসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলতে চলতে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া পার হয়ে সবচেয়ে বেশি যানজটে পড়তে হয় মিরপুর–১০ নম্বরের সিগন্যাল পার হওয়ার আগে। ১৩ মিনিটের মতো সময় লাগে এ সিগন্যাল পার হতে। এখানকার যানজটের বড় কারণ সোজা ও উল্টোপথে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনিয়ন্ত্রিত চলাচল এবং ব্যক্তিগত গাড়ি।
বাসচালকদের চোখে যানজটের ক্ষেত্রে নতুন আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। এই রিকশাগুলো ঢাকার প্রায় সব সড়কেই এখন চলছে অবাধে। উল্টো পথে, সিগন্যাল ভেঙে, ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অননুমোদিত এই যানগুলো। তাদের সামলাতে ট্রাফিক পুলিশকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সিগন্যাল ছাড়ার পর থেমে থেমেই বাসটি পৌঁছায় মিরপুর–১২। তখন ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে ১২টা। ৮টায় কুড়িল থেকে যে যাত্রার শুরু, রাজধানীর দক্ষিণ প্রান্ত হয়ে উত্তর প্রান্তের মিরপুরে পৌঁছতে লাগল সাড়ে চার ঘণ্টা। অর্থাৎ দিনের প্রায় অর্ধেকই কেটে গেল ঢাকার সড়কে, বায়ুদূষণের মধ্যে।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটও রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে রাজধানীর সড়কে যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অর্থাৎ দেড় দশকে রাজধানীতে যানবাহন চলাচলের গতি কমে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটারের মতো।
বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ঢাকায় যানবাহনের গতি সরকারের নানা উদ্যোগের পরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও ধীর হচ্ছে। ২০২৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরের মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা।
৯ অক্টোবর ঢাকার কোনো দল বা সংগঠনের কোনো কর্মসূচি ছিল না। ফলে সড়কে বাড়তি কোনো ঝঞ্ঝাট ছিল না। তার মধ্যেই কুড়িল থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার এবং সেখান থেকে মিরপুর পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার সড়ক যেতে মোট সময় লাগল ৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট।
মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ের পেছনে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে; বাস ব্যবস্থাপনা ও যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি?